by রজত  শুভ্র  চ্যাটার্জি
 ০০৭৯
“ সীমার মাঝে অসীম তুমি,
বাজাও আপন সুর
আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ
তাই এত মধুর “ –
আমাদের মায়ের শতবর্ষ ২০২৬ এর ৭ সেপ্টেম্বর। বাবার শতবর্ষ উদযাপন করেছিলেম আমরা ভাইবোনরা ২০১৭ তে  এস ও এস ভিলেজে বাবার নামে অনুদানের মধ্যে দিয়ে। মায়ের শতবার্ষিকী এখনও দু বছর পরে। ততদিন আমি নিজে  টিকবো কি না খুব বিশ্বাসি নই। এই মুহূর্তে, নিজেকে মনে হয় একটা expired tablet. আগাছার মতো সমাজে এখনো ভেসে আছি। তাই নিজের মায়ের প্রতি আমার  প্রানভরা ভালবাসা ও আমার মত করে মূল্যায়ন(?) করবার চেষ্টা এই ক্ষুদ্র  গণ্ডির মধ্যে।  মা কে মূল্যায়ন ? সে আবার কি কথা ? মা মা ই। এর কোন বিকল্প হয় না।
রামকৃষ্ণ ভাবধারায় প্রবাহিত হওয়ার পরে, শ্রী শ্রী সারদা মায়ের কৃপায় এতটাই অনুপ্রানিত যে নিজের গর্ভধারিণী জননী অগোচরে চলে যেতে  বসেছিল।  কিন্তু, রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের অনুচ্ছেদেই বলা আছে, নিজের  গর্ভধারিণী মাকে  ব্রহ্মজ্ঞ্যানে স্মরণ করতে পারলে অনেক বেশি শান্তি পাওয়া যায় । এক জাগতিক মাকে  ছেড়ে অন্য মাকে ধরে শান্তি পাওয়া যায়, ঠিকই।  পরম ভক্তি রসও উপলব্ধ্য হয়। তবু নিজের  গর্ভধারিণী মা সর্বশ্রেষ্ঠ, এই বিষয়েও কোন দ্বিমত নেই। জীবনের  অভিজ্ঞতাই শেখাল।
এই লেখাটা লিখতে আমাকে ভাবিয়েছে, বাপি – ( অভিজিত লাহিড়ী ) – লাহিড়ী মাসিমার বড় ছেলে –  যে আপাতত, প্রবাস ছেড়ে এডি ৩১৩ তেই থাকে।  বলল, বড়দা, তোমার লেখা এতো ভাল, তা জেঠিমা কে নিয়ে একটা কিছু লেখো।
শ্রী শ্রী সারদা মা বলেছেন – “ ভয় কি বাবা ?  আমি মা থাকতে আবার ভয় কিসের ? কেউ না থাক, সব সময়ে জানবে, আমার একজন মা আছেন“।  এ এক পরম আশ্বাস বানী।
আমি তো আমাদের মা কে ‘জননী’ বলেই নীচ থেকে হাক পারতাম। আমাদের গর্ভধারিণী মা  ছিলেন, এক উজাড় করা ভালবাসার নাম। এতো ভালবাসা মা পেয়েছিলেন কোথাথেকে ?  মা কে আমার স্মরনে আছে আমার ৩/৪ বছর বয়স থেকেই। তখন আমরা হালিশহর / কাচরাপাড়া থাকতাম। বাবার গাড়ি চালানো শেখা ওই  সময়েই। বড় একটা এনভিএফ ভ্যান নিয়ে বাবা আমাদের সকলকে নিয়ে বেরাতে যেতেন । মা সবসময়েই আতঙ্কে থাকতেন। এই নিয়ে অনুরোধ, উপরোধ, অনুযোগ সবই চলত। কিন্তু, হিটলার তার মেজাজেই গাড়ী চালাতেন।    সেই প্রথম উপলব্ধি করলাম, আমাদের জন্য, বাবার জন্য- মায়ের উদ্বেগ ও ভালবাসা। সেই মা যখন  ১৯৫৯/৬০ এ  কান্দি রাজ কলেজে ভর্তি হয়ে গেলেন আই এ ক্লাসে, তখন একবারও ভাবেন নি মহকুমা হাকিম সাহেবের বউ এর অমর্যাদা হল কি না ?   এর পর, ৬২ তে প্রাইভেটে বি এ,  বাংলায় অনার্স পাশ করে মামাবাড়ির সব্বাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন। তখন চোখের সামনে দেখেছি, কি অমানুষিক পরিশ্রমে পাঁচ সন্তানকে লালন পালন করেও, সুইনো স্ট্রিটে বিটি তে ভরতি হলেন।  বিটি ও পাশ করলেন। কুট্টি মামা সন্দেশ নিয়ে এসে জানিয়ে গেল। এরপর এম এ। তাও হয়ে গেলো ! সে কি আনন্দের দিন গেছে আমাদের। বাবা, যে বাবা, মামাবাড়ির সবাইকে ডেকে খাওয়ালেন। আর ৬৬ সি পার্ক স্ট্রিটের দিকে উড়ে গেলো এক অব্যাক্ত উপহাস। আমরা ডায়মন্ড হারবার চলে গেলাম।  শুরু হোল মায়ের দীর্ঘ শিক্ষক জীবন।
ডায়মন্ড হারবার এ মা হেঁটে স্কুলে যাতায়াত করতেন। তারপর, রানিকুঠিতে থাকাকালীন মা এক অবর্ণনীয় পরিশ্রমের মধ্যে স্কুল করেছেন। বাস পালটিয়ে শিয়ালদাহ স্টেশন থেকে ট্রেনে করে স্কুল করা, তখন বুঝিনি, এখন অনুভব করি, কি অসাধ্য সাধন কাজ ছিল। কেউ কি জানে, মায়ের স্কুলে কোন ফ্যান ছিল না ! সেই সময়ে, আমরা ভাই বোনরাও খুব কষ্ট করে স্কুল /কলেজ করেছি। বাপি, বাব্লুর হাত ধরে ৪১/১ এ উঠে, ডেভিড হেয়ার এ নেমে, বাব্লু কে স্কুলে পউছে, অতটা হেটে ল্যান্সদাউন এ নিজের স্কুলে যেত আবার ওই পথেই ফিরে আসা। এ সবই মায়ের অনুপ্রেরনা। মায়ের সেই স্কুল জীবন শেষ হয়েছিলো ১৯৯১ তে, যখন জোর করে আমরা আর মাকে স্কুলে যেতে দেইনি।  মায়ের শরীর ক্রমাগত খারাপ হওয়ার জন্য।
“ মা , মানে দীর্ঘ শাল্মলী । মা , মানে চিরহরিৎ গাছ । মা , মানে “খিদে পেয়েছে , ভাত দাও ।” মা , মানে সাতখুন মাফ । মা , মানে শাড়ি’র গন্ধ । মা , মানে জ্বরের জলপট্টি । মা , মানে রূপের কাছে সব রূপসী মাথানীচু । মা , মানে হাতের লেখা শেখানো । মা , মানে জলবসন্তে রাত জেগে গায়ে নিমপাতা বোলানো । মা , মানে জন্মদিনে ছবি । মা , মানে আঁচলের খুঁটে কানের গোড়ার ময়লা পরিষ্কার । মা , মানে পিঠে হাত বুলিয়ে দিলে মনেহয় স্বর্গে যেতে গেলে কে বলেছে মরতে হয় ?!  মা , মানে যার কাছে এখনও আমি সদ্যোজাত , যে এখনও আমার মুখে কাঁচা দুধের গন্ধ পায়…”
আমাদের মা এর থেকে আলাদা কিছু ছিলেন না।
কালের নিয়মেই পরিবারে এসেছে,  অজিতদা, মুরলি, এদিকে স্বপ্না, সুপ্তি, বনি। ভরে উঠেছিল মায়ের সংসার । তবুও হাড়ভাঙ্গা খাটুনির মুল্য চোকাতেই হলে মাকে। অনেক ভোরে বেরিয়ে, ১/১.৩০ র সময়ে যখন ক্লান্ত, বিদ্ধস্ত হয়ে ফিরতেন, তখন স্বপ্নার হাতে এক গ্লাস লেবুর সরবত মা খাটে বসেই নিতেন। স্নান সেরে, স্বপ্নার সাথেই দুপুরের খাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়তেন। নিয়মের হের ফের হতই। অনেক  দিন, খাওয়া সেরেই হয়ত স্বপ্না কে নিয়ে  ছুটতেন জয়া সিনেমা হলে। টুকুন কে রেখে  যেতেন লাহিড়ী মাসিমার কাছে, খাবার, জল সমেত। আমি জানতেও  পারতাম না। আরেক দিন  হয়ত টুকুন কে হাত ধরে  চলে যেতেন যোগদ্যানে। আমার কিম্বা স্বপ্নার কোনো অনুমতির প্রশ্নই ছিল না। টুকুন যেতো স্বামী ভুতেশানন্দজী মহারাজের হাত থেকে লজেন্স পাওয়ার আশায়। উপরি  পাওনা ছিল, সুরা জুট মিল।  টোটনের সাথে দেখা হওয়ার সুতীব্র বাসনা।  সেখানেও  ভালো মন্দ পাওয়াই যেতো মনির কাছে।  এছারাও, টুকুন কে নিয়ে অনেক বার ট্রেনে  করে আহারামপুর সাহারা স্কুলে অনুষ্ঠানেও নিয়ে গেছেন, আমি জেনেছি অফিস   ফেরত। এ সবই হয়েছিল, ১৯৭৫  থেকে ১৯৯৭ – দীর্ঘ ২২ বছর পাশের ঘরে মাকে পাওয়ার জন্য নৈকট্য । পরে যখন ২০০০ সালে ফিরে এলাম, তখন তো মা ভেজিটেবিল ।
দেখেছি, টোটনের জন্য মায়ের কি চিন্তা ও স্নেহ। টোটন যখন বাপির হাত ধরে এডি ছেড়ে সন্ধ্যেবেলা ফিরে যেত, তখন অনেকদিনই মাকে চোখের জল ফেলতে   দেখেছি। আমিও খুব কষ্ট পেতাম।  দেখেছি, মিষ্টিকে কি পরিমান ভালবাসতেন । আদরের বড় মেয়ের মেয়ে বলে কথা!  তার উপর অমন জামাই।  বিজয় যেন, অজিত দার রেপ্লিকা।  অজিত দা র টাক নিয়ে কেউ একজন কটাক্ষ করায়, মায়ের সপাট হুক। বলেছিলেন, অমন রুপবান  ইঞ্জিনিয়ার একটা  এনে দেখিয়ে দাও তো !  সুপ্তির প্রতি দেখেছি, কি যত্ন করে আলাদা রান্না হত !  ও সব কিছু খেতে পারত না বলে। কোনদিন, বনি কিম্বা স্বপ্না কে মনক্ষুন্য হতে  দেখিনি। তবে হ্যা, মিঠুনের জন্য থাকতো স্পেসাল কিছু। মিলির ছেলে বলেই,  মিঠুনের  জন্য মায়ের ভালবাসা বোঝা যেতো । যখনি যেতেন,  তখনি ব্যাগ ভর্তি করেই যেতেন ।
ঠাকুর ঘরে মা যখন যেতেন, টুকুন তিন চার বছর বয়েসে  ঠিক উঠে যেতো সিঁড়ি বেয়ে নিঃশব্দে । মায়ের পাশে বসে নারায়ণ শিলা নিয়ে আরম্ভ করত ওর খেলা। মা যত বারন করত, টুকুন মেতেই থাকতো ওর খেলায়। কতবার যে নারায়ণ শিলাকে হাত থেকে ফেলেছে আর মা বকুনি দিয়েছে তা গুনে শেষ করা যাবে না। টুকুন বলত, এটা ত একটা পাথর! এই ভাবেই চলত ঠাকুমা আর নাতির খুনসুটি ।  টুকুন একটু বড় হতে, মা শুধু বলতেন, বাপি কাকু আর বাপ্পা কাকুকে দেখবি। ওদের মত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
মায়ের সাম্যবাদের একটা ঘটনা বলি। টুকুনের ৪/৫ বছরের জন্মদিনে মা পায়েস  করেছেন। মায়ের পায়েস মানে সবাই জানে। চিনি ভর্তি, তার সাথে, কাজু, কিসমিস,  কর্পূর দিয়ে এক অপূর্ব পরমান্ন ।  আমি খেয়ে  বলেছিলেম, মা এতো রিচ করেছ, যে বেশি খাওয়া গেল না। মা মুচকি হেসেছিলেন। এর পরের জন্মদিনটাই ছিল টোটনের। সেদিনও একই স্বাদের একই পরমান্ন। সেদিনও আমি অনুযোগ করায়, মা বলেছিলেন, আমার কাছে সবাই সমান । আমি বাপু আলাদা কিছু করতে পারব না।
অপূর্ব। এখন বুঝি, মায়ের কথাই  বলেছেন শ্রী শ্রী সারদা মা। শ্রী মা বলছেন, আমার কাছে আমজাদও ছেলে, শরতও ( স্বামী সারদানন্দ ) ছেলে।
এটা দুর্ভাগ্যের , যে জিকো, পিয়া, তুয়া, তুলি, প্রিয়াংশি –  মা কে পেলই না। বিজয় কিছুটা  পেয়েছে। এটা ওর সৌভাগ্য । নাতি, নাতনিদের কথা তো ছেড়েই দিলাম।  যারা আমাদের মাকে পায় নি, তারা জানলই না, জীবনে কি না পাওয়া থেকে গেলো ।
আমাদের জীবনে দুঃখ আসবে, বেদনা আসবে, আসবে বিপদ, আনন্দের পাশাপাশি ই।  প্রারব্ধ্য  যা, তা ভোগ করে যেতেই হবে।  তবু, মা নাম করে যেতে পারলে, আপদ বিপদ   কিছুটা হলেও কম হবে  বিশ্বাস করি।   “ মা নাম শেখাতে  সবে – এসেছ এ ভবে “ ।।
“ তাই  তোমার আনন্দ আমার প’র
তুমি তাই এসেছ নীচে –
আমার নইলে,  ত্রিভুবনেস্বর
তোমার প্রেম হতো যে মিছে। “
মাগো, স্বপ্নে হলেও, তোমার , শুধু তোমার নিজের দুঃখ কীসে একটু জানিও তো ! আর দেখো , তোমার সাধের চ্যাটার্জি, ব্যানারজি, চক্রবর্তী, ভাট্টি  পরিবারে সম্পর্ক যেন অটুট থাকে। ছোটরা এখন ভীষণ ব্যাস্ত। ওদের কোনো  ফুরসত নেই। তবু ……….
Concluded…

 

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here