রজত শুভ্র চ্যাটার্জি
০০৫৮
আজ গিয়েছিলাম কথামৃত ভবন দর্শনে। সঙ্গী হয়েছিলাম শ্যামল মিত্র ( আধ্যাত্মিক দাদা বন্ধু ) ও অশোক গুপ্ত র ( পূর্বতন চীফ সেক্রেটারি )।
আমাহারস্ট স্ট্রিট আর ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির সংযোগকারি বেঁচু চ্যাটার্জি স্ট্রিট ধরে একটু এগিয়েই ডানদিকে ঘুরতেই পেয়ে গেলাম ১৩/২, গুরু প্রসাদ চৌধুরী লেন। এটাই ‘শ্রী ম’ র বাড়ি। মহেন্দ্রলাল গুপ্ত। কথামৃতর লেখক। লেখক না বলে, বোধহয় কলমধারি বললে ঠিক ঠাক বলা হয়। যে কথামৃত আমাদের মত বহু বহু মানুষের দিক নির্ণয়ে রসদ যুগিয়ে চলেছে, যুগ যুগ ধরে, ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের সেই অমৃত সমান উক্তি গুলোকেই পংক্তিভুক্ত করে গড়ে তুলেছিলেন কথামৃত – এই মহেন্দ্রলাল গুপ্ত। শ্রী ম। বহুদিনের ইচ্ছে পূরণ হলো, শ্রী ম র বাড়ি দেখার। অসাধারণ ভক্ত ছিলেন ঠাকুরের। শ্রী শ্রী মা কে করতেন অসম্ভব ভক্তি ও শ্রদ্ধা।
তিনতলা বাড়ির একতলায় লাইব্রেরী। দোতলায়, শ্রী ম র ঘর, যে ঘরে বসেই তিনি কথামৃত লিখতেন। রয়েছে তার শয্যা। তার ব্যবহৃত পাদুকাদ্বয়। ঠাকুর এসে ওই ঘরে কতবার থেকেছেন। ভাবা যায়, ঠাকুরের স্পর্শ করা ঘরে আমরাও। ছোট্ট একটুখানি ঘর । অথচ, কি তার মাহাত্য। কি তার নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি ।
এবার তিনতলায় যাবার সময়। সামনে একটি কাঠের সিড়ি। শ্রী শ্রী মা ওই কাঠের সিড়ি বেয়ে অজস্রবার ওঠা নামা করেছেন। কারণ মা তিনতলায় ওই ঘরে এসে অনেক অনেক দিন কাটিয়েছেন। সিড়িটি এতই খাড়া, যে আমাদের উঠতে এবং অবশ্যই নামার সময়ে বেশ বেগ পেতে হলো। ভেবে অবাক না হয়ে পারছি না এই জেনে, মা কত সহজে ওই সিড়ি দিয়ে ওঠা নামা করেছেন।
তিনতলায় ঘরে ঢুকতেই এক শান্তির চমক। ঠাকুর, মা র পুজো ছাড়াও ওই ঘরে নিত্ত নারায়ন পুজো হয়। গোপাল ঠাকুর ও রয়েছেন। চমকের তখনও বাকি। ঠাকুর, মায়ের ছবি বিগ্রহ তো রয়েছেই, বিস্ফোরিত চোখে দেখলাম, মায়ের পায়ের ছাপ ( মা দেহ রাখার পরেই )। রয়েছে মা ও ঠাকুরের চুল। দেখলাম, মায়ের পুজো করা ঠাকুরের ছবি, ঠাকুরের পাদুকাদ্বয়। মায়ের ব্যাবহার করা ঘট । মায়ের জপের মালা । সব অতি যত্নে সুরক্ষিত । গায়ে কাঁটা দেওয়ার মত। শ্রী শ্রী মা ওই ঘরে, শুনলাম, অনেকবার, অনেকদিন কাটিয়েছেন। আমরা অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম। ধ্যান তো সহজে আসেনা। কিন্তু ওই ঘরে এমন কিছু তো আছেই, যা আমার মত মানুষকেও মাটিতে আটকে রেখেছিলো বেশ কিছুক্ষন।
একতলার ঘরে, স্বামীজি ও তার প্রায় সব পারিষদগণ অনেকবার এসে বসেছেন, আলোচনা করেছেন। সেই অর্থে, ওই একতলার ঘরও পরম পবিত্র স্থান। প্রকৃতপক্ষে, শ্রী ম র ওই বাড়িটিই এক পরম পূজিত তীর্থ ক্ষেত্র। একতলার ওই ঘরে বসে মহারাজের সাথে কথা বলার ফাকেই জানলাম ও বুঝলাম , ওই ঘরের পবিত্রতা।
শ্রী ম র দুটো ইচ্ছে হয়েছিল। ঠাকুর কে বলেওছিলেন। এক তো, ঠাকুরের সাথে কামারপুকুর যাবেন। আর দুই, ওই বাড়িতে দুর্গাপূজা করবেন। ঠাকুরের তখন ভগ্ন স্বাস্থ। প্রথম ইচ্ছেটি পূর্ন হয় নি, কারন ১৮৮৬ র ১৬ আগস্ট ঠাকুর দেহ রাখলেন। কিন্তু ঠাকুর চলে যাবার পর, শ্রী শ্রী মা স্বপ্নাদেশ পান ঠাকুরের। সূক্ষ্ম শরীরে ঠাকুর দেখা দিয়ে মাকে বলেন, শ্রী ম র বাড়িতেই দুর্গাপূজা করতে হবে। শ্রী ম যখন মায়ের থেকে এই কথা জানলেন, তখন শ্রী শ্রী মা কেই জীবন্ত দুর্গা রূপে পুজো করে ওই বাড়িতে শ্রী ম তার ইচ্ছে পূরন করেছিলেন।
পাশের বাড়িতেই মঠ। মহারাজ কে প্রণাম করা হলো। ফল প্রসাদ পেয়ে এবার ফেরার পালা। শ্রী ম র প্রপৌত্র দীপক কুমার গুপ্তর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ২০১৬ সালে ওই বাড়ি দুটি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন বেলুরের অন্তর্গত হয়। দীপক গুপ্ত যদিও আজ আর ইহলোকে নেই।
এই ছিলেন মহেন্দ্রলাল গুপ্ত। দক্ষিণেশ্বরে, কাশিপুর উদ্যান বাটিতে, ঠাকুরের সাথে যাতায়াত করতে করতে যখন যেমন শুনেছেন ঠাকুর বাণী তখন তেমন মনে রেখেছেন নয়তো চিরকুট লিখে রেখেছেন। পরে নিজের ওই ঘরে বসে শোনা, চিরকুট থেকে লিখে গিয়েছেন – যা আমরা পেয়েছি কথামৃত হিসেবে।
জয় ঠাকুর। জয় মা। জয় স্বামিজি।