রজত  শুভ্র  চ্যাটার্জি

০০৮৪

জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে পিছনে ফিরে তাকালে অনেক অপ্রাপ্তি চোখের জলে ভেসে ওঠে। যদিও এর কোনো মানেই খুঁজে পাইনা কারণ, জীবনে অপ্রাপ্তিই বেশি থাকে। প্রাপ্তি থাকে খুব সামান্যই। তাই, না পাওয়ার খেদ একেবারেই থাকা উচিত নয়। অন্তত আমার মতো সামান্য এক  জীবনধারীর। স্বামীজী তো বলেইছেন,  জীবনে, সুখ ও দুঃখের মধ্যে যেমন দুঃখের, খারাপ সময় থাকে বেশি, অল্প সুখের পরেই যেমন নেমে আসে দীর্ঘতর দুঃখের সময়, এই অপ্রাপ্তির ব্যাপারটাও ঠিক একই  রকম।

স্বপ্ন সবাই  দেখে। স্বপ্ন ছাড়া জীবনের গতিপথটাই তো তৈরি হবে না।  ছোটো বেলার স্বপ্ন, বেশির ভাগ স্বপ্নই থেকে যায়। কিছু সত্যি হয়। কিছু হয় না। আমিও ব্যতিক্রম নই। স্বপ্ন দেখেছিলাম দশ বছর বয়েসে, যদি কখনো, চুনি গোস্বামীর সাথে দেখা করতে পারি। পরবর্তীতে, শুধু দেখা নয়, চুনি দার সাথে, বিপক্ষে খেলেছি ক্রিকেট ও যথেষ্ট সখ্যতাও ছিলো আমার স্বপ্নের মানুষটার সাথে।  যা ভোলার নয়। ভেবেছিলাম, টেস্ট ক্রিকেটার হবো, নিদেন পক্ষে রঞ্জি তো খেলবই। সেই আশা পূরণ হয় নি। রঞ্জির ধারে কাছেও পৌঁছতে পারিনি। কোনো দুঃখ নেই কারন বুঝেছিলাম, ওই লেভেলটা আমার জন্য নয়। এছাড়া, পেরেছিলাম, আরো এক স্বপ্নের মানুষ,  টাইগার পতৌদির সামনা সামনি হতে, বার কয়েক। একবার, ছোট্ট ইন্টারভিউ নেবারও সুযোগ মিলেছিল।  কথা বলেছি। সেটাই প্রাপ্তি।

ক্রিকেট খেলাতে খুব এগুতে না পারলেও, ক্রিকেট নিয়ে লিখেছি যথেষ্ট। সত্যি, যথেষ্ট। এই ব্যাপারে আমি নিশ্চই কৃতজ্ঞ আমার বন্ধু, ভাই, এখন আমরা – বেআই, – দেবাশীষ দত্তর কাছে। ওর অদম্য উৎসাহে কাগজের পাতায় দিনের পর দিন লিখেছি। যার জন্য, পরবর্তীতে বেশ কিছু বই লেখার রসদও যোগাড় হয়েছিল। এটাও  প্রাপ্তি।  সেই পনেরো বছরে মাঠে নেমেছিলাম ক্রিকেট নিয়ে। আজ মধ্য সত্তর পেরিয়েও  মাঠেই আছি, সপ্তাহান্তিক টেনিসের সৌজন্যে। এটাও তো প্রাপ্তিই।

তবু, তবু, এতো প্রাপ্তির মাঝে, কাঁটার মতো বিঁধে আছে, গান না গাইতে পারার জন্য। একেবারে ছোট্ট বেলাতেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম গান কে, আমার দিদির প্রশ্রয়ে। ষাটের শুরু থেকেই, রেডিও তে অনুরোধের আসর শুনে ভাললাগা শুরু।  কণ্ঠ পরিচিতি , অখিলবন্ধু, হেমন্ত, শ্যামল, মানবেন্দ্র, দ্বিজেন, তরুণ, সতীনাথ, মান্না, মৃণাল, সুবীর, কিশোর, জটিলেশ্বরদের সাথেই, সন্ধ্যা, প্রতিমা, আরতি, নির্মলা, লতা,  আশা, সুমন,  বনশ্রীর কণ্ঠও। সেই কালের গান মনের মধ্যে যে তুফান তুলেছিল তা আজও অস্তমিত হয়নি কারণ এটাই যে সেই সব গান ছিলো ও থাকবে চিরদিনের জন্য। তখন নিয়ম করে মহিষাসুরমর্দিনী শুনতাম মহালয়ার ভোরে। সেই ভালোলাগা অচিরেই ভালোবাসায় পরিনতি লাভ করে, যখন সাগর সেন কে মন দিয়ে শুনি। পরে সাগর দা র কাছাকাছি থাকার দরুন সেই ভালোবাসায় পড়েছিল এক অনন্য অনুভূতি যা আজো মাথা থেকে নামাতে পারিনি।

অজস্র বাংলা ও হিন্দি গানের ডালি থেকে আমার অর্ঘ সাজানো খুব কঠিন এক কাজ। সেই চেষ্টা না করে, আমি শুধু এটাই বলি, ওই সব গানের সুরকার ও গীতিকার যারা ছিলেন, তারাই মনের মধ্যে গেঁথে দিতে পেরেছিলেন এক অসাধারণত্ব। যা যুগ পেরিয়ে, কাল পেরিয়ে অনন্তের পথে আন্দোলিত। এর পরেও, বেশ কিছু গাইয়ে বাজিয়ে দের পেয়েছি। যারা আধুনিকতার ছোঁয়া বাঁচিয়েও চিরন্তন থাকতে পেরেছে। শ্রীকান্ত এর এক অপূর্ব নিদর্শন। আর আমি, মাথা খুঁড়েছি,  একটু  গান গাইবার জন্য। এতো ভালোবাসার একটা উপদান আমি পেয়েও পেলাম না। এই আক্ষেপ আমার অপ্রাপ্তির ভান্ডার পূর্ণ করে রেখেছে।

যুবক যখন, তখনই বাবার হাত ধরে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের দিকে আকৃষ্ট হয়ে, সব সঙ্গীত সম্মেলনে উপস্থিত হতাম একটু গান বাজনা শোনার জন্য। কলামন্দিরের স্টেজে  বসে যে রাতে আলী আকবর আর স্বপন চৌধুরী কে শুনলাম সেই ১৯৭০ এ, তখন থেকেই মাথাটা ঘুরে গেল।  গড়ের মাঠে, বাবার সাথে মাটিতে বসে বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে গভীর রাত পেরিয়ে ভোরের আলোর ছটায় যখন  সুনন্দা  পট্টনায়কের  গলায় শুনলাম – ‘মাত যা যোগী’, তখন নিজেকে হারিয়ে  ফেলেছিলাম। বাড়ি ফিরেছিলাম হালকা হাওয়ায়  ভেসে। তখনকার বি ও এ সি র বড় কর্তা জ্যোতিষ গাঙ্গুলির ফ্ল্যাটে পায়ের কাছে বসে নিখিল বাবু কে শোনা র পর গান বাজনা নিয়ে পাগলামি বেড়েই গিয়েছিল। অনেক পরে, যখন নিজে উচ্চাঙ্গ  সঙ্গীত  আসরের আয়োজন করেছি বছরের পর বছর, তখন তো ফল্গুধারার মতো গানের স্রোতেই ভেসেছি। সে এক পরম অনুভুতির। পরম কিছু প্রাপ্তি।

খুব ইচ্ছে হয়েছিল, সরোদ নয়, সেতার বাজানোর। পারলাম কই? বুড়ো বয়সে গিয়েছিলাম পাতানো এক ভাইয়ের বউয়ের কাছে সেতার শিখবার আশায়। হলো না। ধরতেই পারলাম না সেতার ! বাজানো অনেক দূরের ব্যাপার। কেন বলা এইসব?  এই জন্য, গান বাজনা শিখবার আমার যে এক অদম্য ইচ্ছে বয়ে নিয়ে চলেছি অন্তত কয়েক দশক, সেটা আজও কিন্তু জলন্ত আগুনের মতো আমাকে পুড়িয়ে চলেছে। পুরিয়ে হয়তো আমাকে শুদ্ধ্য  করছে !

গানটা কিন্তু আমি গাইতে পারলাম না। গলায় সুর ছিলো। সবাই তো তাই বলতো।  তালের গরমিল ছিল না। লয় ব্যাপারটাও আয়ত্বে ছিল। তবু হলো না।

এখনো, প্রতিদিন, একটা দীর্ঘ সময় আমি গান বাজনা শুনি। সব রকমের।  এফ এম, টিভি ও  ইউ টিউবে। বয়স বাড়ার সাথে এটাই প্রাপ্তি যে গান শোনা আমার কাছে এখন দারুন এক আকর্ষণের। গান আমার মন কে হালকা করে। মাথা ব্যথা কমিয়ে দেয়। দুশ্চিন্তা দূর করে, আর ঘুমোতে সাহায্য করে। আর কি ? আর ইষ্ট কে স্মরণ করিয়ে দেয়। আগে গান শুনতাম ভালবেসে। আজও তাই। এর সাথে যখন গানের কথাকে মেলাতে পারি ইস্ট দেবের সাথে, তখন মাধুর্যময় হয়ে ওঠে   গান শোনা ব্যাপারটাই । অবাক মনে ভাবি, রবি ঠাকুরের কতো কতো গান শুধুই ঈশ্বরে নিবেদিত। প্রেম, পুজা, প্রকৃতি পর্যায়ের। আগে শোনার কান ছিল। বোঝার মন ছিল না।  ধরিয়ে দেওয়ার সুত্র ছিল না।

এটাই তো পাওয়া। নিজে না হয় গাইতে পারলাম না।  অন্যের গান তো শুনতে বাধা নেই। তাই নিয়েই কাটিয়ে দেবো বাকি দিনগুলি। এখন তো আর বছরের হিসেবে বলি না। বলি, দিনের হিসেবে। আমি না থাকলেও গান নিয়ে আমার পাগলামির অনেক চিহ্ন রয়ে গেল আমার পরিমণ্ডলে।

সমাপ্তি।

পরবর্তী সময়ে আসার ইচ্ছে রইলো, সঙ্গে নিয়ে, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে আমার  প্রত্যক্ষ্য –  ‘আখো  দেখা হাল’ ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here