রজত  শুভ্র  চ্যাটার্জি

০০৭১

আজ আরো এক ২ মে।

আরো এক সত্যজিৎ জন্মদিন।  প্রণাম বরণীয় এই ভারতীয়কে। যদিও, সত্যজিৎ রায় দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে সারা বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন ভারতীয় সংস্কৃতিকে। রবি ঠাকুর কে দেখিনি। পেয়েছি ওকে, ওর  অসীম সাহিত্য,  সঙ্গীত আর কাব্য ভান্ডারের মাধ্যমে। সত্যজিৎকেও সেই ভাবে দেখা হয়নি। তবু আমার মত  একজন মুখোমুখি হতে পেরেছিলাম সত্যজিতের। অবাক লাগবে শুনতে। কিন্তু ঘটনাটা ঘটেছিল বহুকাল আগে, ১৯৭৪ এর এক সকালে। ওঁর জন্মদিনে এটাই আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য।

আমি তখন GKW তে কর্মরত। আমার সেই সময়ের অধিকর্তা পালিত দা ওই সময় সংকলন করছিলেন, “দশ বছরের সেরা ছোটো গল্প” – বইএর আকারে। ওই বই এর  জন্য লেখা সংগ্রহ করার গুরু দায়িত্ব অনেকের মত আমার উপরও বর্তে ছিলো।  এখনো ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। আমার দায়িত্ব পড়ল – আশাপূর্ণা দেবী এবং সত্যজিৎ রায়ের কাছ থেকে গল্পের ম্যানুষ্ক্রিট নিয়ে আসার।

এক বিকেলে  গড়িয়ায়  আশাপূর্ণা দেবীর বাড়ি গিয়ে নিয়ে এলাম ওর গল্প। সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা। পরে অন্য পরিসরে বলা যাবে। আজ সত্যজিৎ দিবস।

দুদিন পরে এক সকালে হাজির বিশপ লেফ্রয় রোডে সত্যজিৎ সকাশে। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় যখন পৌঁছলাম তখন বুকের ভিতর হাপর আঘাত হানছে। বেল টিপতেই একজন দরজা খুলে আমার কথা জেনে ভিতরে বসতে বললেন। আমি ঘরে ঢুকে বসবার আগে চারদিকে তাকিয়েই দেখি, এতো সেই ঘর, বহু ছবিতে দেখা। ওই তো সেই আরাম কেদারা যাতে বসেই সত্যজিৎ রায় তৈরি করতেন  ওনার যাবতীয় শৈল্পিক সৃষ্টিকলা।

বসে আছি। ঘরে কেউ নেই। কিন্তু পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে কথপোকথন। তারই মাঝে সেই ব্যারিটোন। বুঝতে পারছিলাম, উনি কারো সাথে কথা বলছিলেন। সবটাই ইংরেজিতে।

একসময় শেষ হলো পাশের ঘরের কথাবার্তা। একটু পরেই পাশের ঘর থেকে এদিকে আসতে থাকলেন বেশ কয়েকজন, যাদের হাতে দেখলাম BBC লেখা মাইক্রোফোন, মুভি ক্যামেরা ইত্যাদি। সবার শেষে উনি –  সত্যজিৎ রায় – সাদা লম্বা কুর্তা  পায়জামায় ছ ফুট চার ইঞ্চির দীর্ঘকায় মানুষটি। বোঝা গেলো, BBC র কোনো ইন্টার্ভিউ চলছিল।

অতিথিরা বেরিয়ে যেতে সত্যজিৎ ঘুরলেন আর আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই বলে উঠলেন, ওহ, তোমাকেই কি পালিত পাঠিয়েছে ? আমি ঘাড় নাড়তেই বললেন, একটু বসো, আমি আসছি। মিনিট খানেকের মধ্যেই ফিরলেন, হাতে একটা খাম। বললেন, নাও, পালিতকে দিও। আমি খামটি হাতে নিয়েই দরজা মুখী। বুকের ভিতর তখনও ধড়াস ধড়াস। পিছন থেকে হঠাৎই সত্যজিতের ব্যারিটোন –দাড়াও । আমি পিছন ফিরতেই, উনি কাছে এগিয়ে এলেন এবং সরাসরি আমার চোখের মধ্যে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন – তুমি কেমন ছেলে ! আমার কাছে এলে। আমার হাত থেকে লেখা নিলে আর চলে যাচ্ছ ?  আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করার নেই  তোমার ?

আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। শুনেছি, প্রবল দুঃসময়েও কখনও কোন এক শক্তি ভর করে। আমারও তেমন হোলো। একটু থতমত খেয়েও সাহস করে বলে ফেললাম – ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সাহস পাচ্ছিলাম না। উনি হেসে ঘাড় নারলেন। আমি উৎসাহিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম – আচ্ছা, আপনার সিনেমায় এমন কি থাকে,  যাতে এক্কেবারে প্রথম মুহূর্ত থেকেই সব্বাই সোজা হয়ে বসে দেখতে থাকে। সত্যজিত বুকে হাত রেখে বললেন, একটা শব্দ বন্ধ আছে – Hook & Hold –  তার মানে, আমি আমার সিনেমায় প্রথমেই এমন কিছু রাখতে চাই, যাতে সিনেমা দেখতে আসা সকলেই প্রথম মুহূর্ত থেকেই আকৃষ্ট হতে পারে । তারপর তো আমার কাজ ওদের ধরে রাখা। তাকেই বলে  Hook & Hold. আমি সেটাই করতে চেষ্টা করি। অমন একজন মাপের মানুষের কাছ থেকে কি সরল স্বীকারোক্তি ! পরবর্তীতে, আমি নিজে যখন  ব্লগ লিখতে শুরু করলাম, তখন দ্বিধাহীন চিত্তে আমার ব্লগের নামকরণ ওই ধার করা শব্দবন্ধ দিয়েই – Hook & Hold.

কৃতজ্ঞতা ! অমন মানুষের কাছে শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ ক’জন পায়। আমি ধন্য।

concluded

 

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here