রজত শুভ্র চ্যাটার্জি
০০৬৯
২০০২। মোহনবাগানে সে বছর যোগ দিয়েছে দুই ব্রাজিলীয়, ডু আর বেতো। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলো ছোটখাটো চেহারার, নিষ্পাপ চাহনির এক পাহাড়ি কিশোর। সুনীল ছেত্রী। মোহন কোচ সুব্রত ভট্টাচার্য সেই সময়ের মোহন সেক্রেটারি বলরাম চৌধুরীর মাধ্যমে চাইলেন একটি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলার – টিম কে ঝালিয়ে নেবার উদ্দেশে। ঠিক হলো, সি সি এফ সি মাঠে সম্মিলিত সিসিএফসি একাদশের সাথেই খেলবে মোহন বাগান। ম্যাচটা আয়োজনের ভার পড়েছিল এই অধমের উপরই।
খেলার সন্ধ্যায় আলো ঝলমলে মাঠে প্রবল বৃষ্টিতে ধুইয়ে যাওয়া ঘাসে সেদিন ফুল ফুটিয়েছিল দুজন। একজন ব্রাজিলীয় বেতো আরেকজন ওই পাহাড়ি সুনীল ছেত্রি। খেলা শেষে, সিসিএফসি র দোতলায় খাবারের জায়গা। সেখানে এক কোণে চুপ চাপ বসেছিল সুনীল। আমি গিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলাম – শ্যাম থাপার নাম শুনেছ ? সুনীল বলল, শুনেছি কিন্তু দেখিনি। আমি বললাম, দেখবে কি করে ? তোমার জন্মের আগেই তো শ্যাম খেলা ছেড়েছে। তবে, একটা কথা বলি। তুমি যদি নিজেকে ধরে রাখতে পারো, তবে একদিন তুমিও শ্যাম থাপা হয়ে উঠতে পারবে। মনে আছে, সুনীল আমার হাঁটুতে হাত দিয়ে প্রণাম করে মাথায় ঠেকিয়েছিল।
দীর্ঘ ২২ বছর পরে এই লেখার সময় পিছন ফিরে তাকালে চোখের সামনে ভেসে উঠছে, সুনীলের যাবতীয় কীর্তি, ভারতীয় ফুটবলে। দেশের হয়ে একশো গোল ছাড়াও, ক্লাব ফুটবলে সুনীল দু দশক ধরে যে ভাবে বিপক্ষের কাছে আতঙ্কের প্রতীক হয়ে উঠেছিল সেটা ওর ফুটবল প্রতিভা ও পরিশ্রমের ফসল। চুরান্ত টিমম্যান, মাঠে ওর অত্যন্ত সদাচারন ও খেলার প্রতি দায়বদ্ধতা সুনীলকে করে তুলেছে এক নায়ক চরিত্রে। তবু, এতো করেও কিন্তু সুনীল পারেনি, ভারতীয় ফুটবলকে এক চুলও উন্নীত করতে। সত্তরের দশকে ভারতের ফুটবল যে উচ্চতায় উঠবে আশা করা গিয়েছিল, আশির দশকের পর থেকে সেই ফুটবল যে গতিতে ও নিশ্চিত ভাবে অধঃপতনের দিকে এগিয়েছে, তার জন্য অপটু প্রশিক্ষণ এবং একই সাথে চূড়ান্ত অযোগ্য ফুটবল পরিচালনা সমান ভাবে দায়ী থাকবে। সুনীল ও তার সতীর্থরাও কিন্তু এই অধঃপতনের অংশীদার। এতেও কোনো দ্বিধা থাকার কথা নয়।
ষাট দশকের ভারতীয় ফুটবল খেলা হতো অত্যন্ত ভারী চামড়ার ফুটবল দিয়ে। তখনকার ফুটবল বুট ও ছিলো ভারী, ও মোটা চামড়া দিয়েই তৈরি। এমনকি, বুটের স্পাইক লাগানো থাকতো চামড়ার। এই সময়ে এক পায়ের বুটের ওজন থাকতো ১৫০০ গ্রামের মত। দেশের ভিতরে তখন ফুটবল খেলা হতো ৫০ মিনিটের। অথচ, ওই ফুটবলাররা , আন্তর্জাতিক ফুটবলে অনায়াসে ৯০ মিনিটের ফুল ফোটানো ফুটবল খেলতেন। সেই অর্থে, সুনীলরা তো আধুনিক ফুটবলের সরকম সুযোগ সুবিধা পেয়েও প্রায় কিছুই করতে পারল না। সিনথেটিক বল, নাইলনের অথবা ক্যাঙ্গারু leather এর বুট (যার একটি বুটের ওজন ২০০ গ্রামেরও কম), অত্যাধুনিক ক্রীড়া বিজ্ঞানের দৌলতে পাওয়া পেয়িন কিলার ইত্যাদি সুনীলদের দিয়েছে এক অনন্য সাচ্ছন্দ্য । তবু, এক আধটা সাফ গেমস বা কখনও সখনও অপ্রত্যাশিত কিছু জয় নিয়েই এতো বছর চালিয়ে গেলো। যে এশিয়ান গেমসে এক সময়ে ভারত চ্যাম্পিয়ন ছিল, এখন সেখানে একটি ম্যাচও জিতে আসতে পারেনা। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে বিদেশী কোচের পিছনে অনর্থক সময় দিয়ে কর্তারা যেমন দেশীয় ফুটবলের কোনো মানোন্নয়নই করেননি, সুনীলও তেমনি এই প্রায় চল্লিশেও খেলে চলেছে প্রতি ম্যাচেই প্রায় কিছুই না করে। সেই কারণেই, এর আগে বাংলাদেশ, নেপাল, মালদ্বীপের কাছে হারতে হয়েছে। এখন আফগানিস্থানের কাছেও হার। মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।
সুনীল, ব্যক্তিগত ভাবে নিশ্চই এদেশের সর্বকালের সেরাদের তালিকায় থাকবে তবু দলগত ভাবে সে যে চরম ব্যার্থ এটা অস্বীকার করার জায়গা নেই। নিজের প্রতিও সুনীল অবিচার করেই চলেছে এখনও খেলা চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে। ভারতীয় ফুটবলে সময় এসেই গেছে, সুনীল, গুরপ্রিত ছাড়া চিন্তা করতে। বিকল্প না পাওয়া গেলে, এখনকার থেকে খারাপ আর হওয়ার কিছু বাকি নেই।
concluded…