রজত শুভ্র চ্যাটার্জি

০০৩০

“ ফুল ফুটুক না ফুটুক, আজ বসন্ত “ –
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এই লাইনটি ধার করেই শুরু করি। সত্যি, আজ বসন্ত। তা না হলে, এই মাঝ বসন্তের গনগনে আঁচে এমন মন কেমন করা অথচ প্রাণ ভরিয়ে দেওয়া একটা দিন কাটাতে কি পারতাম ?

সিনিওর সিটিজেন তো হয়েছি – তাও বহুকাল । তবে আজো টের পাইনি কি এর মাহাত্ম। মাহাত্ম থাকতেই হবে তারও কোন মানে নেই । বয়েস বেড়েছে। বাপু, চুপচাপ থাকো । চাইতে যেওনা কিছু, কারো কাছে – এই পন্থা অবলম্বন করেই এক যুগেরও বেশি পার করে দিয়েছি। শোনা গিয়েছিল, কিছু কিছু সুবিধে নাকি পাওয়া যেতে পারে। আজ অবধি অবশ্য তেমন কোন কিছু এই কপালে জোটেনি। কি এমন কপাল যে জুটতেই হবে ! কি করেছি জীবনে যে সিনিওর সিটিজেন হিসেবে কিছু সুবিধে আমার প্রাপ্য হবেই !

ঠিক এইরকম যখন আমার চিন্তা ভাবনা, সেই সময়েই হটাত করে কিছু কিছু সংগঠনের তরফে কিছু কিছু সন্মাননা জুটেও যাচ্ছে । এটাও কপাল। এইতো, কিছুদিন আগেই প্রাধান অতিথির আসন তৈরি ছিল আমার জন্য, নারী দিবসের দুই অনুষ্ঠানে। আমি যাইনি। কেউ বলছে, আবৃত্তি করে দিয়ে যান। পারলে যাচ্ছি। না পারলে, দুঃখ প্রকাশ করছি। কেউ, সংগঠনের প্রধানের দায়িত্ব দিতে চান । আমি সবিনয়ে প্রত্যাখান করছি। যে বয়েসে পৌঁছেছি, সেখানে এখন শুধুই নিজেকে সময় দাও আর আনন্দে থাকার চেষ্টা করো – এই ব্রতই নিয়েছি। আর হ্যাঁ, টেনিসটা ছাড়তে পারিনি , অনেক শারীরিক অসুখ ও অসুবিধে কাটিয়ে উঠেও , টেনিসটা চালিয়ে যাচ্ছি। এরই মধ্যে, ওই “ আজ বসন্ত“ র আনন্দ এসে উপস্থিত । বিধাননগর পুলিশ এর সাথে গাঁটছড়া বেধে এক এন জি ও আমাদের জন্যই তৈরি করেছে – ‘ সাঁঝবাতি ’ নামে এক সংস্থা – সিনিওর সিটিজেনদের নিরাপত্তা ও সময়ে সময়ে পাশে থাকার অঙ্গিকার নিয়ে। সেই সাঁঝবাতির একান্ত অনুরোধে গত ২২ শে মার্চ আমরা কিছু বয়স্ক মানুষ সাথী হয়েছিলাম ওদের। আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বারুইপুর অঞ্চলে এক অনাথ শিশু নিকেতনে – যার পরিচালন ভার ন্যস্ত আছে OFFER নামে আরেক এন জী ও র হাতে। তাদেরই তৈরি আনন্দঘর আর আপনজন ।

অসাধারণ এক অভিজ্ঞতার মধ্যে আমরা তিন চার ঘন্টা কাটিয়ে এলাম। আমরা বলতে জনা কুড়ি বৃদ্ধ, বৃদ্ধা । এই শিশু নিকেতনের মুলত দুটি বিভাগ। এক ভাগে থাকে এইচ আই ভি আক্রান্ত ছেলে মেয়েরা – আলাদা আলাদা হস্টেলে । আর এক ভাগে থাকে প্রকৃত অর্থে শারীরিক ভাবে অসমর্থ ও অশক্তরা। এইচ আই ভি আক্রান্ত নয়, শুধুই অনাথ, এমন ছেলে মেয়েরাও থাকে আরো একটা আলাদা বিভাগে। একদিকে সে এক মর্মান্তিক চিত্র। আবার আরেক দিকে, প্রচণ্ড ভাবে পজিটিভিটির বিচ্ছুরণ। এই যে প্রায় অসম্ভব মেলবন্ধন – সেটা সম্ভব হয়েছে – আমরা দেখে এলাম – এই হোমের কেয়ারটেকার ও ম্যানেজারদের অক্লান্ত পরিশ্রমে, ভালবাসায় নত ও সদা হাস্যময় চাহনিতে। সবটাই স্বতঃস্ফূর্ত, আন্তরিকতায় ভরপুর। লোক দেখানো একেবারেই নয় –সেটা অনুভবেই বোঝা গেল। মেকি ব্যাপারটাই নেই। ওই ছেলেমেয়েদের মুখে এক চিলতে হাসি ফোটাবার জন্য এরা প্রান দিয়েই কাজ করে চলেছেন । ওঁদের মুখেই জানলাম, এইচ আই ভি আক্রান্ত ছেলে মেয়েরা প্রত্যেকেই স্কুলে যায় । প্রথম প্রথম স্কুলে অনেক আপত্তি ছিল। এখন সব ঠিক ঠাক । নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যখন বিকেল বেলা ছেলে মেয়েরা সব স্কুল থেকে ফিরল । ছেলে মেয়েদের গড় বয়েস ১০/১২। খুব ছোটরাও আছে। আবার বড়রাও রয়েছে । ১৮ হলে এদের হোমে না রেখে কাছাকাছি রেখে এমন কিছু ব্যবস্থা করা হয় যাতে নিজেরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে । মেয়েরা সব ইউনিফরম পরে স্কুল থেকে ফিরল। আমরা ওদের থামালাম। ওদের নাম জিজ্ঞাসা করলাম। সব্বাই বেশ সুশ্রী এবং স্মার্ট। ওরা জানে ওদের অসুখ। তবু, মুখে তার লেশ মাত্র নেই। দেখে, আমাদের আনন্দাশ্রু লুকোতে হোল । এতই পজিটিভ ওরা । অবশ্যই, ওদের মধ্যে যারা শুধুই অনাথ, কোন অসুখ নেই, তারাও একসাথে বড় হচ্ছে । একসাথে খেলা করছে। ছেলেদের মধ্যে দু বছরের শিশুও আছে। যারা একটু বড়, তারা আমাদের সামনে যোগ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন আসন ও ভঙ্গিমা তুলে ধরল অসামান্য দক্ষতায় ।

ছেলেদের হোস্টেল ঘুরে, আমরা মেয়েদের হোস্টেলে গেলাম। সেখানেই মেয়েদের সাথে পরিচিত হলাম । আমাদের দেখে ওদেরও কি আনন্দ ! ওদেরই মধ্যে একটি মেয়ে- শুধুই অনাথ, নেই কোনো অসুখ, তার শুনলাম বিয়ে হবে। বছর ১৮ হবে মেয়েটি । খুবই সুন্দরী । লাজুক । বিয়ের কথা শুনে ছুটে পালালো । হোস্টেল লাগোয়া আছে এক হাসপাতাল, যদি হটাত কেউ অসুস্থ হয়ে পরে । ডাক্তার আসেন সপ্তাহে দুদিন নিয়ম করে।

ওদিকে ছেলেদের হোমে যখন ফিরলাম তখন দেখি দুই দলে ফুটবল খেলা চলছে। সেই দুই দলে অসুখ আছে ও নেই – দুই রকমের ছেলেরাই খেলছে। বোঝাই যাবে না। আর যারা শারীরিক ভাবে অসমর্থ , তারা রেলিং এর পাশে দাড়িয়ে তাদের মত করে আনন্দ করছে । কি স্বাভাবিক আবার আমাদের কাছে কি ভীষণ অস্বাভাবিক ! হোমের পরিচালকরা দেখলাম সবার সাথেই খুব স্বাভাবিক ভাবেই কথাবার্তা বলছেন, ঠাট্টা খুনসুটি সবই হচ্ছে – অকাতরে। এরা সবাই গান গায়। কবিতা বলে। নিজেদের মধ্যে আনন্দ করে। কত খারাপ খবরে মন ভারাক্রান্ত হয় যখন শুনি, বিভিন্ন অনাথ আশ্রমে কতরকমের অনিয়ম । এখানে এসে একেবারেই উল্টো ছবি দেখলাম নিজের চোখেই। যে যেমন পারলাম দিলাম ওদের সাহায্যের জন্য । আমার গৃহিণী নিয়ে গিয়েছিলেন অনেক বিস্কুট আর চকোলেট । তাই পেয়ে বাচ্চাদের কি আনন্দ ! এমন নয় যে ওরা এইগুলো পায় না। কিন্তু আমাদের কাছ থেকে পেয়ে মনে হল যেন , নিজের জনের কাছ থেকে পেলো ওরা। এই যে নিজের বলে ভাবতে পারা, অসহয়তাকে আশ্রয় না করে নিজের পায়ের জমি শক্ত করে বাঁচতে চাওয়া, দেখে আবারো বিহ্বল হতে হোল ।

ফিরে আসতেই হোতো । বাস যখন ফিরতি পথের রাস্তায়, তখন দেখি, সার দিয়ে দাঁড়িয়ে সেই সব মলিন মুখে হাসি উথলে উঠেছে । ওঁদের দলে ছিল সেই মেয়েটিও – যে আমাদের চা ইত্যাদি খাওয়ালো। যে কানে শোনে না। কথাও বলতে পারে না। আকারে ইঙ্গিতে কিন্তু বেশ কথা বলছিল আমার গৃহিণীর সাথে। দেখি, সেও, হাসি মুখে, চোখ মুছতে মুছতেই হাত তুলে বিদায় জানালো।

রবি ঠাকুরের গানের লাইন আমাদের চোখ ধুইয়ে দিয়ে গেল –
“ মলিন মুখে ফুঁটুক হাসি , জুরাক দু নয়ন “ ।

Featured Images : Self taken

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here