রজত  শুভ্র  চ্যাটার্জি

হিমেল বাতাসের খবর মিলেছে। শীত আসলেই মনে পড়ে, সদারং সঙ্গীত, তানসেন সঙ্গীত, পার্ক সার্কাস সঙ্গীত, সুরেশ সঙ্গীত, ডোভারলেন সঙ্গীত সন্মেলনের কথা।  খূব ছোটো বয়েসে,  বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্গীত  সন্মেলনে গিয়েছিলাম বাবার হাত ধরে।  কলকাতার  ময়দানে তখন হোতো।  আমার অনেক কিছু ‘প্রথমের’ সাথেই বাবা জড়িত । ময়দানে প্রথম খেলা দেখা ’৫৮ তে। ইডেনে ’৬০ সালে, রিচি বেনোকে দেখা বাবার হাত ধরেই। বাবা আমার মধ্যে সঙ্গীত  প্রেমের একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিলেন। একদিন রেডিওতে  রম্যগীতির  অনুষ্ঠানে, সতিনাথ মুখোপাধ্যায়ের গান হচ্ছিল। আমি স্বগোতক্তির মত বলেছিলাম, এর গীতিকার হচ্ছেন দীপ  নারায়ণ মিঠড়ীয়া। অনুষ্ঠান শেষে সঞ্চালক যখন দীপ নারায়ণ মিঠড়ীয়ার  নাম বললেন, বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, “ তুমি এত গভীর ভাবে গান শোনো” !! এর সুত্র ধরেই আমার বঙ্গ সঙ্গীত আসরে  যাওয়া ।

ত্রিপলের উপর বসে, ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে, সারা রাত গান শোনার সে এক অপূর্ব অনুভুতি, পরবর্তী সময়ে আমাকে  আরো বড় কাজ করতে প্রেরনা জুগিয়েছিল। সেই রাতে শুনেছিলাম, মণ্টূ ব্যানার্জির হারমোনিয়াম। মালকোষ ।  আমীর খাঁ সাহেবের গলায় দরবারী। নবীন, ইমরাত খানের সেতারে  আহীর ভৈঁরো।   একেবারে নতুন তখন, সুনন্দা পট্ট্যনায়েকের গলায়,  মাত যা, মাত যা, মাত যা যোগী  – সেই প্রথম শোনা। বছর বারো তখন আমি । কিন্তু যে স্বাদ আমার পাওয়া হয়েছিল, আজ ভাবি, না পেলে,  কি যে না পাওয়া থাকতো । এর পর, যখন যেখানে সুযোগ  পেয়েছি, চলে  গেছি।  একা একাই ।

একটু বড় হতে, বন্ধু শ্যমলের দিদির বাড়িতে, মনিলাল নাগ কে শুনলাম  সামনে থেকে।  জয়জয়ন্তী – ওঃ অসাধারন। তখন আমরা বালিগঞ্জ  সার্কুলার  রোডে থাকি। উলটো দিকের এক প্রাসাদপম বাড়িতে থাকতেন, তখনকার ব্রিটিশ এয়ারের কর্তা – জ্যোতিষ গাঙ্গুলি। ওনার ছিল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রতি দুর্বলতা । ওর ছেলে, আমার অনুজ, বাব্লু, আমায় এক শনিবার জানাল, যে আজ সন্ধায়, নিখিল ব্যানার্জি বাজাবেন ওদের বৈঠক খানায়।

হৃদয় আমার উঠিল নাচিয়া  – এর আগেও, জ্যোতিষ বাবু আমাকে বিশেষ ভাবে দু একবার  ওনার  ড্রইং রুমে নিয়ে গল্পটল্প করেছেন – কারন তখন আমি গেস্ট কিন উইলিয়ামসে চাকরি  করছি।  পাড়ায়, ভালো ছেলের স্ট্যাম্প পরে গেছে। জ্যোতিষ বাবুর অন্তঃপুরে, দামি স্কচও পেয়ে গেছি। ৭২ সাল। তখন ত্রিকোণ প্রেমে হাবুডুবু । ক্রিকেট , ক্লাসিকাল  মিউসিক, আর ভাবী ঘরণী ।  চাকরীতে যাই,  গেস্ট কিনের নীল রঙা বাসে চড়ে । সে এক ম ম অবস্থা। তো, সেই সন্ধায়, নিখিল বাবুর সামনে বসে শুনলাম, মিশ্র  কাফি তে আলাপ আর পিলু ধুন। মনে হচ্ছিল, স্বর্গের কাছাকাছি। সাথে, স্কচ, দু পেগ। বিশাল খাবারের আয়োজন ছিল। কিন্তু, আমার মাথায় তখন, মিশ্র  কাফি। বাড়ি ফিরলাম চার পা হেটেই বুঁদ হয়ে।

এর দু সপ্তাহ বাদেই  জ্যোতিষ গাঙ্গুলি, ছেলের হাত দিয়ে আমায় পাঠালেন কলামন্দিরের অনুষ্ঠানের এক আমন্ত্রন পত্র। চোখ ছানাবড়া  হবার যোগাড় । আলি আকবর খাঁর সরোদ, সাথে  তবলায়, স্বপন চৌধুরী । লটারি পাওয়া !!

নির্দিষ্ট দিনে ( দিনটাও ছিল শনিবার – আমার স্বাপ্তাহিক ছুটির দিন ) কলামন্দিরে পৌঁছেতেই, দেখা জ্যোতিষ গাঙ্গুলির সাথে। প্রবল ভিড়ের মধ্যেও উনি আমায় টেনে একেবারে ষ্টেজের মধ্যে। সেই প্রথম আমার কলামন্দিরের স্টেজে  পৌঁছানো । এরপর, কত অনুষ্ঠানের  আয়োজক ও উপস্থাপক আমি ছিলাম  ওই মঞ্চে !!  যাই হোক, সেদিন এতই ভিড় হয়েছিল, যে আমাদের বসার ব্যবস্থা হল স্টেজের মধ্যেই সাদা ফরাসে, আলি আকবর কে ঘিরে। এতো কাছ থেকে ওই অনুষ্ঠান শোনা ও দেখার সৌভাগ্য, জ্যোতিষ গাঙ্গুলি না থাকলে হতই না। সেই অর্থে, আমার বাবা যদি আমার উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত প্রেমের  দিকনির্দেশক হয়ে থাকেন, তবে নিঃসন্দেহে, সেটাকে প্রভাবিত ও  প্রবাহিত করেছে  জ্যোতিষ গাঙ্গুলির ভালোবাসা , প্রশয় আর সঙ্গীত প্রেম।

সেই শুরু। এরই ফলশ্রুতি – ’৮৮  তে প্রথম সল্টলেক মিউসিক ফেস্টিভ্যাল করলাম, বিবি-বিসি পার্কে – সারা রাত ব্যাপি অনুষ্ঠান । আমাদের প্রথম প্রেসিডেন্ট করেছিলাম পণ্ডিত এম আর গৌতম কে।  সল্টলেকেই থাকতেন। প্রখ্যাত কণ্ঠ শিল্পী, ওনার চেষ্টায় তখনকার রাজ্যপাল, নুরুল হাসানকে এনে অনুষ্ঠানের সুচনা করতে পেরেছিলাম । আর আনতে পেরেছিলাম, অসংখ্য নামী সে সময়ের বাজিয়ে, গাইয়েদের । হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া,  বিসমিল্লা খান, শিবকুমার শর্মা, ডঃ বিনয় ভরত রাম, হিদায়েত খান, ইমরাত খান, সুনন্দা পট্ট্যনায়েক , শিপ্রা বসু,  মানস চক্রবর্তী, কিশান মহারাজ , গোবিন্দ বসু, অনিন্দ চ্যাটার্জি র মত সিনিয়রদের পাশাপাশি ছিলেন অনেক নবীন প্রজন্মের শিল্পীরাও। সুগত নাগ, সারথি চ্যাটার্জি, প্রভৃতিরা ।  দারুন জমেছিল অনুষ্ঠান ।  হ্যা, বাবা ও জ্যোতিষ গাঙ্গুলির আলাপ ওই অনুষ্ঠানেই ।

এর পরের বছরে, ’৮৯ এ  আমরা কলামন্দিরে দুই সন্ধ্যা ও এক সারারাত ব্যাপি অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পেরেছিলাম ।  আই টি সি স্পন্সর করেছিলো – ‘গোল্ডেন গ্রেটস’ – এই শিরোনামে।  সেও এক সুন্দর অনুষ্ঠান । হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া,  নয়না দেবী, উপালী অপরাজিতার   ওডিসি, বাহাদুর খান ও কিরিট খানের দ্বৈত সেতার-সরোদ যুগলবন্দী , রাশিদ খানের মালকোষ, পার্থ  চ্যাটার্জির সেতারে দরবারী  এবং সবশেষে গিরিজা দেবীর কণ্ঠে ভৈরবী । হল ভর্তি শ্রোতা, বাইরে বেরিয়েছিলেন পুব আকাশে সূর্যকে নিয়েই ।

তারপর বছর দুই তিন আমরা অনুষ্ঠান করেছিলাম বিড়লা সভাঘরে। টাটা টী র আনুকুল্যে। আজকের পূর্বায়ন চ্যাটার্জি, কৌষিকী চক্রবর্তী দেশিকান , শুভ্রা গুহ, রাজীব চক্রবর্তী , প্রত্যূষ ব্যানার্জি, শাহিদ পারভেজ এদের প্রায় সকলেরই আমাদের স্টেজেই প্রথম বড় অনুষ্ঠান । তেজেন্দ্রনারায়ন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ও  অজয় চক্রবর্তী অন্তত , তিনবার  করে আমাদের  মঞ্চে বাজিয়েছেন ও  গেয়েছেন। আমরা ধন্য ।   এছারাও আছে অগুনতি নবীন অথচ  প্রতিভাবানরা যারা উচ্চাঙ্গ সংগীতকেই  করেছে জনপ্রিয়। বিড়লা সভাঘরের এক সন্ধায় আলি আকবর খাঁ সাহেব এসেছিলেন শুধু অনুষ্ঠান শুনতে । আমরা হতবাক । বিড়লা সভাঘরে নিয়মিত শ্রোতা থাকতেন  জ্ঞ্যানপ্রকাশ ঘোষ । উলটো দিকেই ওনার বাড়ি থাকাতে সুবিধা হোতো ।

সব ভালো কিছুরই একটা সময় থাকে। বাবা চলে গেছেন ২০০০ সালে। জ্যোতিষ  গাঙ্গুলির  প্রয়ান ২০০৫/৬ সালে ।   আমার তাল টাই কেটে গিয়েছিল । এই ভাবেই বেশ কিছু বছর টানা গিয়েছিল। স্পন্সরের অভাব, টাকার অভাবে আমাদের অসুবিধে হতেই থাকল। ২০০৮ পর্যন্ত তবু পেরেছিলাম। তারপর আর পারিনি । পরে একক ভাবে ২০১৩ ও ২০১৪ তে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের অনুদানে দুবছর রবীন্দ্র ওকাকুরা ভবনে দুই সন্ধ্যা ব্যাপি  অনুষ্ঠান করা গিয়েছিল। তারপর আর হয় নি। বিক্ষিপ্ত ভাবে কখনও হয়তো কোথাও কেউ বলেছেন, আয়োজন করে দিয়েছি। শিল্পীদের সাথে যদিও যোগাযোগ অবিচ্ছিন্ন । তাদের ভালোবাসাই আমার পাথেও ।

আজকে, আমার সম্বল , শুধুই  ইউ টিউব । অসাধারন কিছু গাইয়ে ও বাজিয়ে এখনকার এরা সব।  শুধুই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত নয়,  সব রকমের ভালো সুর ও কাব্য শুনতে আগ্রহি।  শাহীদ পারভেজ, রুপা পানেসার কে যেমন শুনি, তেমনি শুনি, পুরনো দিনের গান কিম্বা সাহানা বাজপেয়ীকেও। শেনাওয়াজ জামান এত সুরে গীটার বাজান, মুগ্ধ হয়ে শুনতে হয়। রাতে শোয়ার আগে, এদের সাথে চাইই । সেই ত্রিকোণ প্রেম আজো বহমান।  মিউসিক, বাড়ির ঘরনীর সাথে দুই নাতনী  আর  টেনিস।

ক্যা কারু সজনী ……..

Featured Image : Courtesy : kapurthala.gov.in

 

 

 

 

 

 

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here