রজত  শুভ্র  চ্যাটার্জি

দূর থেকে দেখা আর ভালবাসা জন্মানো এক ব্যাপার। যখন ওই শিল্পীদের নিয়ে প্রত্যক্ষ ভাবে কাজ  করেছি, তখন দেখার, জানার চোখ ও মন দুটোই একেবারে অন্য তাঁরে বাধা হয়ে গিয়েছিল। কতো উষ্ণ ও তরল সান্নিধ্যে আমার সময় কেটেছে, তার হিসেব মেলাতে বসিনি ঠিকই তবু, ‘স্মৃতি সততই সুখের ‘– প্রতিভা বসুই তো বলে গিয়েছেন।   কেউ আছেন, কেউ নেই । তাদের সাথে থেকে বিভিন্ন ঘটনা ও কথা বার্তা আজো জ্বল জ্বল করছে । কিছু মজার, কিছু বেদনার।

শিপ্রা বসু । খুব প্রিয় একজন। শিপ্রা বৌদির সাথে সখ্যতা খুব বেশি ছিল, আমার বউ এর।   আমার বউ কে বলতো , তোকে আমি অপর্ণা সেনের কাছে নিয়ে যাবো । তুই এত ভালোবাসিস ওকে। ঠিক আছে ওর জন্মদিনেই তোকে নিয়ে যাবো ।  এটা চলতই।   প্রথম অনুষ্ঠানের পর  কতো বার শিপ্রা বসু গেয়েছে আমাদের মঞ্চে। গোবিন্দ দা কে নিয়ে রাত  দশটার পরে আসতো আমাদের বাড়ি । তারপর শুরু হতো মজলিশ । গভীর রাত হয়ে গেলেও ডিনার  আর হতো না। শুধুই পাণ মুখে গান। কি সুগন্ধি জর্দা মুখে দিতো যার  থেকে আমাদের দুজনের একটু একটু জর্দার নেশা হয়েছিল।  কতো রাত কেটেছে শুধুই গান শুনে । গভীর রাতে আমরা চারজন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে ধাবায় গিয়ে খেয়ে আবার বাড়িতে জর্দা মুখে গান। গোবিন্দ দার সুরে শিপ্রা বৌদি র গাওয়া ‘ যমুনা কি বলতে পারে ‘ – গানটা ওই বাড়িতে  বসেই প্রথম শোনা । ‘ ওগো আমার আগমনী ‘  মহালায়া র গানটিও আবদারে শোনাত । ওদের বাড়িতে , কখনো, পাইকপারা, কখনো বলরাম ঘোষ  স্ট্রিট এ, খুব মিষ্টি খাওয়া হতো। আমার ছেলে, অভিষেক কে হাতে নাড়া বেঁধে দিয়েছিলো গোবিন্দ দা। ওর  অবশ্য তবলা বাজানো হয় নি। তবু সম্পর্কটা ছিল খুব গভীর ।  বেগম আখতার কে পেয়েছিলো শিপ্রা বৌদি এবং, ওর গায়কীতেও ছিল আখতারি বাঈয়ের অনুসরন। ২০০৮ এর ২২ শে এপ্রিল  হটাত যেদিন চলে গেলো , সেদিন কষ্ট তো হয়েই ছিল , তার থেকেও বেশি ক্ষতি হয়েছিল সঙ্গীতের। মাত্র ৬৩ তে চলে যাওয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি । রবিন্দ্রসদনে শায়িত মরদেহের সামনে চুপ করে ভালবাসা জানাতেও বুকের ভিতরটা দলা পাকিয়ে উঠেছিল । এ তো শুধু একজনের চলে যাওয়া নয়,  অনেক কিছু সাথে করে নিয়ে যাওয়া। এবং, অনেক কিছু ফেলে যাওয়াও। সকলের আদরের দিদিভাই । ২০১৫ তে, শিপ্রা বসু স্মরনে আমরা অনুষ্ঠান করেছিলাম । গোবিন্দদা প্রধান অথিতি  হয়ে এসেছিল।  কিছু সম্পর্ক রয়ে  যায় । এটি তেমনি এক অপূর্ণ সম্পর্ক।

পরিবেশ টা ভারী হোল ?  বেশ !  ২০০১ । গিরীশ মঞ্চে সকালের অনুষ্ঠানে ছিলেন শিব কুমার শর্মা, তবলায় গোবিন্দ বসু। অনুষ্ঠানের পর, শিব জী কে নিয়ে আসা হোল সল্টলেকের  বাড়িতে  লাঞ্চের জন্য। সেদিন মেনু তে ছিল , হাত রুটি , স্যালাড, চিকেন কষা, সাদা ভাত আর পাবদা মাছের ঝোল। স্নান সেরে সাদা ধবধবে চুড়িদার কুর্তা পরিহিত শিবকুমার কে লাগছিল দেখতে অপূর্ব । রুটি চিকেনে কোন অসুবিধেই হোল না। থামলেন পাবদা মাছ যখন ওর পাতে দেওয়া হোল। ইংরেজি, হিন্দি, ভাঙ্গা বাংলায় এতক্ষন চলছিলো । এবারে ওনার  কাশ্মীরি ভাষা বেরিয়ে এলো । বোঝা গেলো , কাঁটা বেঁছে উনি খেতে পারবেন না । অগত্যা, আমার বউ, ওঁর পাতের পাবদা মাছ খুব যত্ন করে ছাড়িয়ে দিতে লাগলো এবং ওঁর খাওয়ার তৃপ্তি দেখে আরো একটা মাছ দেওয়া হোল । উনি সেটাও তৃপ্তি  করেই খেলেন  এবং  পরিশেষে বললেন , বাঙ্গালীর মাছ না খেলে বুঝতাম না কেন এত ভাল!  গোবিন্দ দার খুনসুটি কিন্তু চলছিলই আমার বউ এর সাথে। এখনও গোবিন্দ দা আমার বউ কে ‘ বৌঠান ‘ বলেই সম্বধন করেন। সেই সময়ে মোবাইল ছিল না। হাতের কাছে কোন ক্যামেরাও ছিল না।  ওঁই দুর্মূল্য ছবিটা আর সংগ্রহে রাখা যায় নি। সন্ধ্যায় ফিরতি ফ্লাইটে উঠবার আগে , শিবকুমার শর্মা জী, বলেছিলেন, আবারও মাছ খেতেই উনি আসবেন । এর পরে অবশ্য আর কখনো ওঁকে বাড়ি আনা যায়নি, যদিও একাধিকবার উনি এর পরেও আমাদের মঞ্চে বাজিয়েছেন।

Featured  Image : Courtesy : classicalfm.ca

 

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here