রজত  শুভ্র  চ্যাটার্জি

স্মৃতির ভেতর কুয়াশা জমে থাকে। ধোঁয়া ধোঁয়া সেই  অস্বচ্ছতার আড়াল থেকে  উঁকি মারে অতীত।  মনে আছে, পূর্বায়ন  চ্যাটার্জি মাত্র ১৩ বছরে বিড়লা সভাগরে আমাদের মঞ্চে বাজিয়েছিলো।  কৌষিকী চক্রবর্তী , যখন ১৪ বছরের কিশোরী , তখন টালিগঞ্জের এক অনুষ্ঠানে ওর গান শুনে চমকে গিয়েছিলাম। পরের বছরই, রবীন্দ্র সদনে কৌষিকীর প্রথম অনুষ্ঠান আমাদের মঞ্চে । অনেক পরে, দুজনেই যখন খ্যাতি ও দক্ষতার শীর্ষে , কি আশ্চর্য , ওদের দুজনকেই একই সন্ধায় একসাথে বসাতে পেরেছিলাম পর পর ।  বিদ্যুৎ ভবন মঞ্চে  । শ্রোতাদের  জায়গা দিতে পারিনি । এমনই অবস্থা। মজার ব্যাপার ও ঘটেছিল । সেদিনের অনুষ্ঠান শেষে, এদের মধ্যে একজন আমার কাছে এসে অনুযোগ জানিয়েছিলো  – ‘ কাকু, তুমি  ওকে বেশি সময় দিয়ে আমায় কম  দিলে ‘ !! ওটা একেবারেই অল্প বয়েসের  উদ্বেগ , উৎকণ্ঠা – আমারটা ঠিক ঠিক হোলতো ? স্বস্নেহ হাঁসিতে আমি বলেছিলাম , “ তোমরা হচ্ছো,  সরস্বতির ছেলে মেয়ে ।  তোমাদের চিন্তা কিসের “। আমার শোনা, যন্ত্র ও কণ্ঠ শিল্পীদের মধ্যে এইদুজন অন্যতম সেরা অবশ্যই ।   দুজনের মধ্যে সখ্যতা  ও শ্রদ্ধ্যা অত্যন্ত গভীর।

সত্যি, এরা সব, – শুধু এরা কেন, – যে কোন পারফর্মিং শিল্পী , খেলাধুলার আসরেও  যারা  উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছেছেন , তাদের মনে রেখেই বলছি,  এরা সকলেই ঠাকুরের কৃপা প্রাপ্ত । নাহলে, ওই লেভেলে পারফর্ম করা যায় না । শাহিদ পারভেজ। একেবারে তরুন শাহিদ যে বার প্রথম আমাদের মঞ্চে বাজালো, তখন থেকেই ওর বাজনা একেবারে স্বতন্ত্র। কোন তাড়াহুড়ো নেই। নেই কোন দেখনদারি।  ধীর স্থির। অনেকবারই বাজিয়েছে । কলকাতার এক সিনিয়র গাইয়ে একবার তো ঠাট্টা করেছিলেন , ‘আপনাদের ছেলে আসছে তো পুনা থেকে ?’   আজ তো শাহিদ এক অসাধারন বাজিয়ে । ওর সেতার কথা বলে । গান গায় । প্রতিটি নোট আজো  লাগায়, খুব সুরে, যত্ন করে  ও একেবারে সহজ ভাবে। এতো ভালো তৈয়ারি, মুগ্ধ্য হয়ে শুনতে হয়। একটা বীটও মিস হয় না। তো, এ সরস্বতির বরপুত্রই।

পিছিয়ে যাই । একটু হাসুন ।   ১৯৮৮ র প্রথম ফেস্টিভ্যালে বিসমিল্লাহ খাঁ সাহেব কে একক বাজানোর অনুরোধ করেছিলেন আমাদের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট, এম আর গৌতম । ওঁর কথাতেই খাঁ সাহেবের আগমন এবং সারারাত ব্যাপি অনুষ্ঠানে মধ্য রাতে ওনার প্রোগ্রাম সেট করা হোল । তবলায়, খাঁ সাহেব সানন্দে রাজি হলেন পণ্ডিত শঙ্খ  চ্যাটার্জিকে নিয়ে বাজাতে । সেই সময়ে, খ্যাতির চুড়োয় থাকা বিসমিল্লাহ খাঁ কে বোঝার জন্যই এই গৌরচন্দ্রিকা । ধারে ও ভারে, উনিই ছিলেন, ’৮৮ র স্টার পারফর্মার । এবং, যথারীতি, ওর মেজাজ একটু উচু তাঁরে বাধা থাকতো সদাই।

যথা সময়ে, মঞ্চে অবতীর্ণ হলেন শিল্পী যুগল – প্রাথমিক আনুষঙ্গিকতা সেরে,  যন্ত্র মেলাতে উদ্দ্যত খাঁ সাহেব।  বিখ্যাত ঘোষক দিলিপ ঘোষের কণ্ঠে মন্দ্রিত হোল একক সানাই বাদনের নিবেদন। ঠিক ওই সময়েই ব্যাক স্টেজে , এম আর গৌতম,  গোঁ ধরলেন , উনি ডুয়েট করবেন, সানাই এর সাথে কণ্ঠ সঙ্গীত দিয়ে । আমরা তো হা হা করে উঠেছি । তাও কি সম্ভব ! খাঁ সাহেব একক বাজাবেন বলেই এসেছেন । এখন যদি উনি শোনেন , কণ্ঠ সঙ্গীতের সাথে ডুয়েট বাজাতে হবে, তবে হয়ত এখুনি রেগে মেগে মঞ্চ ছেড়ে নেবে যাবেন।  সে এক অপ্রীতিকর, চরম অস্বস্তিকর অবস্থা । আমরা বোঝালাম , এটা হয় না আর তাছাড়া , আপনার একক গান শুনতেও তো কতো শ্রোতা এসেছেন !  অবশেষে , আমাদের সন্মিলিত প্রয়াসের সামনে উনি থামতে বাধ্য হলেন কিন্তু বললেন, যে উনি মঞ্চে গিয়ে বসবেন, খাঁ সাহেব কে সন্মান জানাতেই । আমাদের বিশেষ কিছু করার ছিল না।  যাই হোক, ইতিমধ্যে, সানাই শুরু হয়ে গেছে । গৌতম গুটি পায়ে মঞ্চে উঠে খাঁ সাহেবের পাশটিতেই বসলেন। মারু বিহাগ । খুব দরদ দিয়েই খাঁ সাহেব বাজাচ্ছেন। অপূর্ব আলাপ পর্ব প্রায় শেষের দিকে, এমন সময়ে, শুদ্ধ মা তে –গৌতমের  কণ্ঠে মিলে গেল সানাই এর রেশ । আমরা হতবাক । খাঁ সাহেব একবার দেখে,  বাজিয়ে চললেন  এবং গৌতম কিছুটা সঙ্গতের ঢঙে ধরে রাখলেন ওনার গায়কী, সাথে শঙ্খ দার তবলা । অনুষ্ঠান মোটেই খারাপ কিছু হয় নি । কিন্তু আমাদের রাগ তখন চরমে। এক ঘণ্টা অতিক্রান্ত। খাঁ সাহেব থামলেন । আমরা ভেবেছি, এর পর উনি নিশ্চিত আরো কিছু বাজাবেন। কিন্তু মুখ গম্ভীর করে সানাই গোছাতে শুরু করতেই, আমাদের মধ্যে একজন, ইশারায়  দিলিপ ঘোষ কে হাত দেখিয়ে,  নিজে মঞ্চে উঠে মাইকের সামনে –  “এতক্ষন উস্তাদ  বিসমিল্লাহ খাঁ সাহেবের সানাই বাদন শুনলেন, সাথে সঙ্গতে ছিলেন, পণ্ডিত শঙ্খ চ্যাটার্জি ও পণ্ডিত এম আর গৌতম “।

ঘোষণা শেষ হতেই , গৌতম একবার ঘোষকের দিকে তাকিয়ে মঞ্চ ছাড়লেন। এরপর আর কখনো আমাদের সাথে তার দেখা হয় নি। আনন্দ পেতে ও দিতে গিয়ে, কত কিছু সহ্য করতেও হয়, এটাও  তো একটা শিক্ষা ।

গিরিজা দেবী কে নিয়ে শেষ করি । প্রথম, ’৮৯ এর কলামন্দিরে সারারাত ব্যাপি অনুষ্ঠানের শেষ শিল্পী ছিলেন  গিরিজা দি । সাথে ছিলেন – তানপুরায় ডালিয়া  রাহুত , হারমনিয়ামে  জ্যোতি গোহো, তবলায় সমর সাহা। ভোর সকালে ওঁর কণ্ঠে ভেসে উঠেছিলো – ‘বাবুল  মোরা , নইহার   ছুট হি যায়’।  কি দরদ, কি ভালোলাগা উথলে ওঠা ওই গানে !!   এরপর, যেটা হোল, সেটা হবারই  ছিলো । নিয়ম করে গিরিজাদি র কাছে যাওয়া আর পরবর্তী দশ বছরে আরো দুবার অন্তত আমাদের মঞ্চে ওনার গাওয়া। এরই মধ্যে সল্টলেকের বাড়িতে ঘরোয়া অনুষ্ঠানেও উনি থাকতেন মধ্যমনি হয়ে । দিদি ’৮৯ তেই যখন পদ্মভূষণ পেলেন, আমরা বাড়িতে এনে সান্ধ্য অনুষ্ঠানের মাঝেই ওনাকে সম্বর্ধনা দিয়েছিলাম। দেওয়া হয়েছিল একটা ঘি রঙের কাতান বেনারসি । অনুরোধ ছিল আমাদের তরফে, এর পর যখন আরো কিছু পাবেন, তখন আমাদের দেওয়া এই শাড়িটি পরবেন। দিদি কথা রেখেছিলেন । অনেক পরে ২০১৬ তে, রাস্ত্রপতি প্রনব মুখারজি র হাত থেকে পদ্মবিভুশন  নেওয়ার সময়ে ওনার পরনে ছিল ওই শাড়িটিই।  দিল্লি থেকে ফিরে উনিই  ফোনে জানিয়েছিলেন ।  সেও এক নীরব আশীর্বাদ।  ২০১৭ য় চলে গেছেন। রেখে গেছেন তার পাদপদ্মে, ছড়ানো অসংখ্য মনি মুক্তো । আর আমাদের মত অবোদ্ধা কিছু গুন মুগ্ধদের ।

Image : Courtesy :  alamy.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here