Rajat Subhra Chatterjee
0051

আজ হাওড়ার রামকৃষ্ণপুর লেনে ওঁ নবগোপাল ঘোষ মশাইয়ের বাড়ি গিয়েছিলাম। বাড়ি তো নয়। মহা তীর্থস্থান। যেখানে স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ এসেছিলেন, ১৮৯৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। সেদিন ছিল মাঘি পূর্ণিমা। কি আশ্চর্য, আগামী পরশুই, ৫ ফেব্রুয়ারি আবারো এক মাঘী পূর্ণিমা। আরো এক পরম যোগাযোগ। আজ ছিলো স্বামীজির ওই বাড়িতে আসার ১২৫ তম বার্ষিকীর দুদিন আগের দিন।

নবগোপাল ছিলেন শ্রী শ্রী ঠাকুরের অতি প্রিয় কাছের মানুষ। গৃহী ভক্ত ও শিষ্যদের একজন। ঠাকুরের প্রতি নবগোপালের ছিল অসীম ভক্তি ও ভালোবাসা। ঠাকুরের সাথে তার ছিল নিত্য ভাব ভালোবাসার আদান প্রদান। কাশীপুর উদ্দান বাটিতে ঐতিহাসিক কল্পতরু দিবসের সাক্ষী। নবগোপাল ছিলেন জর্জ হেন্ডারসন কোম্পানিতে চিফ একাউন্টেন্ট। ওনার স্ত্রী নিস্তারিনি দেবীও ছিলেন ঠাকুর অন্তপ্রানা। কথিত আছে, একদা, ঠাকুর কে মিষ্টি পরিবেশন করে নিস্তারিনি দেবী জ্ঞান হারান। এমনি ছিলো ভাবের ঘোর। তো, টাকাকড়ি নিয়েই ছিল নবগোপালের কারবার। পরিহাসচ্ছলে একদা ঠাকুর বললেন, তোমায় ওই কাঞ্চন ত্যাগ করতে হবে। নতুবা তোমার মুক্তি নেই। নবগোপাল রীতিমত ঝাঝিয়ে বললেন, সেটা কি করে হবে ? ওটাই তো আমার জীবিকা। ওই টাকা পয়সার ওপর নির্ভরশীল কত পরিবার। ঠাকুর তখন হেসে বলেছিলেন, বোঝা গেলো। সেই অর্থে, ওই টাকা তোমার কাছে কাঞ্চন নয়।

ঠাকুর দেহ রাখবার পরে, নবগোপাল, স্বামীজিকে অনুরোধ করে ঠাকুরের একটি মূর্তি স্থাপন করান এই বাড়িতে। মূর্তিটি আসলে, সিরামিকের ওপর এচিং করা। স্বামীজি ওই মূর্তিটি, আনিয়েছিলেন সুদূর বার্লিন থেকে। সেই মূর্তিটি, আজও রামকৃষ্ণপুর লেনের বাড়িতে নিত্য পূজ্য। শুধু তাই নয়, ১৮৯৮ র মাঘী পূর্ণিমার দিনে সেই যে স্বামীজি এনে মূর্তিটি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নৃত্য গানের মাধ্যমে, সেই ট্র্যাডিশন আজও বহমান। প্রত্যেক মাঘী পূর্ণিমাতে, ওখানে সমবেত হন রামকৃষ্ণ সংঘের অনেক সন্ন্যাসী ও সমাজের বিশিষ্টরা। প্রথম দিনের মত, আজও ওই দিন ভক্ত ও সমাগতদের ভোগ বিতরণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদযাপিত হয়। নবগোপালের প্রপৌত্র, শ্রী সুব্রত ঘোষ, বর্তমানে ওই গৃহের মালিক। তবে, নিজেকে একেবারেই মালিক মনে করেন না প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী – ছাত্র ও শিক্ষক সুব্রত। বললেন আমি তো এই গৃহের কেয়ারটেকার। আমার কাজ একে রক্ষা করা। অসাধারণ স্মৃতি শক্তিতে জলের মত বলে গেলেন একের পর এক গল্পঃময় ঘটনা প্রবাহ।

লোমহর্ষক ঘটনা তো এখনও বাকি।

ওই বাড়ির ওই মন্দিরে শ্রী শ্রী মা সারদা দেবীও এসেছিলেন কয়েকবারই। যে পথ দিয়ে মা ও স্বামীজি এসেছিলেন ওই বাড়িতে, সেই পথ আজও অপরিবর্তিত রয়েছে। যে সিড়ি বেয়ে তিনতলার পুজোর ঘরে মা ও স্বামীজি গিয়েছিলেন, তাও একেবারেই অপরিবর্তিত। ঠাকুরের মূর্তি স্থাপন করে স্বামীজি পুজো করে যে প্রণাম মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন, সেটাই আজ, সমগ্র রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রণাম মন্ত্র।

ওঁ স্থাপকায় চ ধর্মস্য সর্বধর্মস্বরূপিনে
অবতার বরিষ্ঠায় রামকৃষ্ণয়তে নমঃ।

আরো একটি ঘটনা। ওই পুজোতেই সংকল্প করা হয় শ্রী শ্রী মা সারদা দেবীর নামে। ওই শুরু। আজও, সকল রামকৃষ্ণ মঠের যে কোনো পুজোতে মায়ের নামেই সংকল্প করা হয়ে থাকে। পূজা সমাপনে ঘোষজায়া নিস্তারিণীদেবীর হাতের রান্না করা খাবার খেয়ে খুব খুশী হয়েছিলেন স্বামীজী। অতঃপর মাথায় বাঁধা পাগড়িটি উপহারস্বরূপ দিয়ে গেলেন নিস্তারিণীদেবীকে।

১৮৯০ সালে নবগোপালের এই রামকৃষ্ণপুর লেনের বাড়িতে আসা। আজ এই বাড়ি এক পূণ্য ভূমি। শ্রী শ্রী মা এই বাড়িতে তিনতলার অপর যে ঘরে যে খাটে শয়ন করেছিলেন, তাও আজ অমলিন, অপরিবর্তিত। অতি পবিত্র স্থান। গেরুয়া চাদরে ঢাকা সেই খাটের উপর বসানো আছে স্বামী অম্বিকানন্দ মহারাজের একটি পেন্টিং। ঘড়ের ভিতর, একেবারে পাশে দাড়িয়ে অনুভব করা গেলো । ঘরের এক কোণে রাখা আছে মিলার এন্ড কোম্পানির সেই হারমোনিয়াম টা, যেটাতে রচিত হয়েছিল – খন্ডন ভব বন্ধন। সেটাও একেবারে কাছ থেকে দর্শন করার সৌভাগ্য হলো আজ। স্বামী চেতনানন্দ মহারাজের লেখনিতে বারবার এসেছে এই বাড়ির কথা। আরো দেখলাম মা গায়েত্রীর ছবি। গায়েত্রী মন্ত্র আমরা প্রতিদিন অজস্র বার উচ্চারণ করে থাকি। কিন্তু গায়ত্রী মাকে আজ প্রথম দর্শন করলাম, হাতে আঁকা একটি ছবির মাধ্যমে। জানলাম, গায়ত্রী মা, হলেন, মহাশক্তির এক অংশ। স্বামী ব্রহমানন্দ মহারাজের ব্যবহৃত পোশাক আশাক দেখা হলো, কাঁচের আলমারিতে রাখা। শুধু স্বামীজি যে সিল্কের পাগড়িটি পরে শিকাগো তে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, নবগোপাল যেটি মাথায় করে নিয়ে এসেছিলেন এই বাড়িতে, সেটি দেখা যায় নি। কাঁচের একটি বাক্সে সেটি সুরক্ষিত থাকে অন্য আরেকটি ঘরে। কেবল মাঘী পূর্ণিমাতেই সাধারণের জন্য সেটির দর্শন হয়।

ঠাকুরের যে মূর্তিটি প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরে, সেটি রুপোর ফ্রেমে বাঁধানো। প্রতিদিন, গত ১২৫ বছর ধরেই জবাকুসুম তেল মাখিয়ে ওই মূর্তিকে স্নান করানো হয়। ওই ঘড়েই পাশে বিরাজ করছেন ত্রৈলঙ্গ স্বামী । আর যেটা দেখে শিহরিত হতে হয়, সেটা হল, পাশে দাড় করানো আছে একটি ত্রিশুল, যেটি ত্রৈলঙ্গ স্বামী নিজে ব্যবহার করতেন।

অন্য একটি ঘর, ‘ মহারাজের ঘর ‘ নামে পরিচিত। তখনও, রামকৃষ্ণ সেবা প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়নি। অসুস্থ স্বামীজিরা এই ঘরে এসে বিশ্রাম নিতেন।

ঠাকুর, মা, স্বামীজির বিগ্রহ দর্শন হলো। গায়েত্রী মা কে দেখলাম। ত্রৈলঙ্গ স্বামী দর্শন হল। মা ও স্বামীজি যেখানে বসে ঠাকুরের পুজো করেছিলেন তাও চোখের সামনে একেবারে স্পর্শ করেই অনুভব করতে পারলাম।

এবারে আসি সেই অভাবনীয় প্রাপ্তির কথায়।

ঠাকুরের মূর্তির সামনে দাড়িয়েই সুব্রত ঘোষ জানালেন, ঠাকুরের মূর্তি যে বেদীতে বসানো রয়েছে, একেবারে চোখের সামনে, তার, নিচেই সুরক্ষিত রয়েছে একাধারে, ঠাকুর, মা এবং স্বামীজির অস্থির অংশ। মনের গভীরে এক ধাক্কা খেলাম। এতো কাছ থেকে ঠাকুর, মা, স্বামীজি কে অনুভব করতে পারার সৌভাগ্য কোনোদিন হবে ভাবিনি। তাই আজকের দিনটি আমার জীবনে এক মহার্ঘ দিন।

কলকাতা থেকে রামকৃষ্ণপুরে যাওয়ার সহজতম হচ্ছে জলপথ। ইডেন গার্ডেনের কাছে চাঁদপাল ঘাট থেকে পনেরো মিনিট অন্তর রামকৃষ্ণপুর ঘাটের ফেরি সার্ভিস আছে। গঙ্গা পেরিয়ে ঘাটে পৌঁছাতে লাগে দশ মিনিট। গঙ্গাবক্ষ থেকে রামকৃষ্ণপুর ঘাটটি খুব সুন্দর দেখায়। একটি মন্দির আছে ঘাটে। দূর থেকে মন্দিরের চূড়োয় পতাকা দৃশ্যমান। ঘাট থেকে পথ চলে গেছে পশ্চিমে জি টি রোড পর্যন্ত। এই জায়গাটি ‘সন্ধ্যাবাজার’ নামে পরিচিত। এখান থেকে রামকৃষ্ণপুর লেন ধরে আরও পশ্চিমে যেতে হবে। কিছুটা এগোলে পল্লীর মাঠের পাশে ৮১নং বাড়িটি ভক্ত নবগোপাল ঘোষ মহাশয়ের। লোকে লাল বাড়ি বা পাগড়ি বাড়ি নামে চেনে। আসলে নাম – নবগোপাল ভবন।

যাদের সাথে গিয়েছিলাম তারাও আমার অতি প্রিয়জন। সজ্জন। তাই, সুজনের সংস্পর্শে মহাতীর্থ স্থান আজ দেখায় ও অনুভবে পেলাম। এ এক পরম পাওয়া।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here