রজত শুভ্র চ্যাটার্জি
০০৩৫
রবীন্দ্রনাথ কে দেখিনি। ওনার সাহিত্য, শিল্পকর্ম ওনার সৃষ্টি ও লেখনীর মাধ্যমেই অনুভব করছি। যতদিন বেঁচে থাকব, রবীন্দ্রনাথ কে ছাড়তে পারব না। কিন্তু ঠিক তার পরেই যে বাঙালি আমাদের মর্মে মর্মে অনুভুত, তিনি সত্যজিত রায় । রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক ও পরে আরো অনেকেই এসেছেন বাংলা সাহিত্য, গান কে সমৃদ্ধ করতে। তারাও প্রনম্য। তারাও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য প্রায়। তবু মনে হয় সত্যজিতের মত বহুমুখী প্রতিভা ও তার বিচ্ছুরন নিয়ে আর কেউ আমাদের সামনে আসেন নি সেই অর্থে ।
সেই সত্যজিতের আজ জন্মদিন, ২ মে। শতবর্ষ পেরুনো সত্যজিত কে কিন্তু আমি দেখেছি একেবারে সামনে থেকে। কথা বলেছি ওনার সুউচ্চ অবয়ব কে সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখে । তবে ক্ষণিকের জন্যই।
আমি যে বহুদিন হলো ব্লগ লিখে চলেছি, সেই ব্লগের নামকরণ নিয়ে আজ পর্য্যন্ত একজনই কেবল উৎসাহ দেখিয়েছেন – কেনো আমার ব্লগের হেডারে থাকে – Hook & Hold । এই শব্দযুগলের উৎপত্তিও সেই মানুষটির থেকেই যাকে নিয়ে আজ আমার এই লেখা। সত্যজিৎ রায়। ছোটো করে সেই গল্পই আজ বলি।
সত্তরের একেবারে গোড়ার দিকে ৭২/৭৩ হবে। আমি আমার প্রথম সাহেবি কোম্পানির চাকরিতে তখনও থিতু হয়ে উঠিনি অথচ, কাজ ব্যতিত অন্য সব কিছুতেই আমার ডাক প্রায় অবধারিত। অফিস ক্রিকেট ও ফুটবল টিম আমাকে ছাড়া হোতই না। এইরকম অবস্থায় আমার উপরওয়ালা একদিন খুব স্নেহের সাথে ডেকে আমাকে এক কঠিন, কঠিন খুব সহজ শব্দ, – এক অসম্ভব কাজের দায়িত্ব দিলেন। উনি দশ বছরের সেরা ছোটো গল্পঃ সংকলনের একটি বই তখন তৈরি করছেন। আমার উপর ভার পড়লো, দুজনের লেখা ওনাদের বাড়ি গিয়ে নিয়ে আসতে হবে। প্রথম জন আশাপূর্ণা দেবী। দ্বিতীয় জন, সত্যজিৎ রায়।
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম। না বলা যাবে না। না বলতে দ্বিধা কারণ এই সুযোগ আর পাবো না। তখন আমার এক কুড়ি কিছু বয়স। দুজন স্বপ্নের মানুষের সামনে গিয়ে দাঁড়াব, ভাবতেই শিহরণ জাগলো। চ্যালেঞ্জটা নিয়েই ফেললাম।
নির্ধারিত দিনে গড়িয়ায় এক সকালে আমি উপস্থিত আশাপূর্ণা দেবীর বাড়িতে। চোখের সামনে দাঁড়িয়ে ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’, ‘সুবর্ণলতা’, ‘বকুল কথা’ র রচয়িতা। আমি পরিচয় দিতে, আমার হাতে ওর ম্যানুস্ক্রিপ্ট তুলে দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। বললেন, “ তোমার নাম কি বাবা“? আমি বললাম। উনি জিজ্ঞেস করলাম, “এতো সুন্দর নাম কে রেখেছিলেন”। তাও বললাম। তারপর খুব মিষ্টি হেসে বললেন, “পারলে আবার এসো”।
আমি প্রণাম করে বিদায় নিলাম হৃষ্ট হৃদয়ে। আর কখনো ফিরে যাইনি অবশ্য। আশ্চর্যের যেটা, সেটা হলো সেবছরে ওনার অনেক বার্ষিক উপন্যাসের মধ্যে একটির নায়কের নাম ছিলো রজত শুভ্র। আজ আর নামটা মনে নেই ।
দুদিন পরে বিশফ লেফ্রয় রোডে। যাকে নিয়ে আজকের লেখা সেই সত্যজিতের বাড়ির দরজায়। নক করতে হলো না। দরজা খোলা ছিলো। আমি গুটি পায়ে ভিতরে ঢুকে গেলাম ছবিতে বহুবার দেখা বিখ্যাত সেই ঘরটির ভিতর। সাহস ভালো। কিন্তু এতো দুঃসাহস ! অপু ট্রিলজির স্রষ্টা, সৌমিত্র চাটুজ্জের আবিষ্কর্তা, তার বিখ্যাত বৈঠকখানায় কিনা আমার মত সবে গোঁফ গজানো এক বালক ! ঘরে ঢুকে দাড়িয়েই আছি আর শুনতে পাচ্ছি, ভিতরের ঘর থেকে আসছে ব্যারিটোন ইংরেজি কথোপকথন।
মিনিট পনের ওইভাবেই দাড়িয়ে ছিলাম,. সম্বিত ফিরল যখন হটাৎ ওই ব্যারিটোন বন্ধ হয়ে গেলো। হটাৎ নিস্তব্ধতার মাঝে দেখলাম, কিছু সাহেব গোছের মানুষ, মুভি ক্যামেরা, স্ট্যান্ড ইত্যাদি নিয়ে বের হয়ে গেলেন সাথে একজন মেমসাহেব যার হাতে ধরা- বি বি সি লেখা একটি মাইক্রোফোন। বোধগম্য হোল যে এতক্ষন বিবিসি কে দেওয়া হচ্ছিল ইন্টেরভিউ। পিছন পিছন সেই প্রায় সাড়ে ছয় ফুট উচ্চতার মানুষটি – সত্যজিৎ রায়। ওদের বিদায় জানিয়ে দরজা থেকে ফিরতেই আমার মুখোমুখি। চোখে জিজ্ঞাসা । আমার পরিচয় দিতেই, “ ওহো তুমি এতক্ষণ দাড়িয়ে ছিলে“ , বলেই ভিতরে গিয়ে ওনার ম্যানুস্ক্রিপ্ট এনে আমার হাতে দিলেন। আমার পা সরছেনা। স্থানুবত হয়ে গিয়েছিলাম। সম্বিত ফিরে পেয়ে নমস্কার জানিয়ে যখন ঘুরে পালাতে উদ্যত, দরজা মুখো আমাকে ডাকলেন – “ওহে শোনো শোনো”। আমি সভয়ে আবার ওনার মুখোমুখি হতেই ওনার প্রশ্ন – “তুমি আমার কাছে এলে, লেখা নিলে, আর চলে যাচ্ছো ? আমাকে সামনে পেয়েও তোমার কিছু জিজ্ঞাসা নেই” ? আমার তো পায়ের তলায় মাটি টলোমলো। কিন্তু, ওই যে বয়েসটায় দাড়িয়ে, তখন হটাৎ বুকে প্রবল বল আর মুখে কথা যুগিয়ে দিলেন ঠাকুর। আমি আমতা আমতা করে বলেই ফেললাম – “হ্যা মানে একটা জিজ্ঞাসা তো ছিলই”।
“তো কি হলো”?
“মানে আপনি কি মনে করবেন তাই ভয় পাচ্ছিলাম”।
এবার সত্যজিৎ খুব জোরে হেসে উঠে বললেন – “বলো বলো কি তোমার জিজ্ঞাস্য”।
আমি তখন দারুন স্মার্ট। বললাম, ( কি করে বলেছিলাম এখন ভাবতেও শিহরন জাগে ) “আপনার সিনেমায় কি এমন থাকে যা একেবারে প্রথম থেকেই দর্শককে আসনে সোজা বসিয়ে রেখে দেয়” ? কেনো বলেছিলাম তাও আজ মনে নেই।
উনি মুখ থেকে পাইপটা সরিয়ে একটু সিরিয়াসলি বললেন – “ইংরেজিতে একটা কথা বলি – Hook & Hold । কিছু বুঝলে” ?
ওই বয়েসে আমার না বোঝাই দস্তুর মনে করেই সত্যজিৎ বলে গেলেন – “আসলে সিনেমার প্রথম দিকেই আমি এমন কিছু একটা রাখি, হয়তো গান কিংবা অপ্রত্যাশিত কিছু সিন যা দর্শককে সিনেমার স্ক্রিনে টেনে ধরে। তাকে বলি Hook. তারপর দু আড়াই ঘণ্টা দর্শককে ধরে রাখাকে বলি Hold । আমার জীবনে জন্ম নিল – Hook & Hold. বছর পঞ্চাশেক আগে শোনা ওই শব্দ যুগল ও তার ব্যাখ্যা কে আমি আমার কর্ম ক্ষেত্রে এর পরে হৃদয় দিয়ে ব্যবহার করেছি, সমস্ত ট্রেনিং প্রোগ্রামে । আজও ওই দুটি শব্দ আমার হাতিয়ার । এই কৃতজ্ঞতা কাকে জানাবো?
এক বৈশাখে তার জন্ম। আরেক বৈশাখে তার চলে যাওয়া । তাই হয়ত খড় রৌদ্রের মতই তার প্রতিভার ছটা । তিনি সত্যজিত – আমাদের গর্ব ।
Featured Image : Collected