রজত শুভ্র চ্যাটার্জি

০০২২

সময়টা ’৭০-৭১ এর গরমকাল। রবীন্দ্রজয়ন্তীর ঠিক আগে। আমার দিদি ইন্দ্রাণী ব্যানার্জি তখনই সাগর সেনের ছাত্রীদের মধ্যে অগ্রগন্যা । রবীন্দ্র সদনে, একাডেমীতে, শিশির মঞ্চে তখনই একক অনুষ্ঠান করে ফেলেছে – ওঁর শিক্ষক গুরুর প্রশ্রয়ে । আমি তখন সেই বয়সটাতে – চাকরি তে সবে ঢুকেছি – নিজেকে যখন বেশ হিরো হিরো মনে হোতো । ক্রিকেট , সঙ্গীত আর প্রথম প্রেম নিয়ে খুবই ব্যাস্ত। ক্রিকেটের বাইরে, হাতে তখন আমার সদাই থাকতো – সুনীল, শক্তির বই আর সাগর সেনের ইপি রেকর্ড। গুছিয়ে আঁতলামো । সাগর সেন তখন বাঙালি যুবকদের হার্টথ্রব । কি যে অসাধারন গাইতেন, আজও বিকল্প খুঁজে পাইনি। নিজের দিদি ছাত্রী, আমি গুনমুগ্ধ ভক্ত অথচ, কোনোদিন ভাবিইনি কোথায় থাকেন সাগর সেন ! কোথায় উনি গান শেখান ! বিয়ে হয়ে যাওয়া দিদিকেও কখনো জিজ্ঞেস করিনি।

তো, সেই প্রখর তপন তাপে এক বিকেলে দক্ষিন কলকাতার এক সরু রাস্তা দিয়ে হেটেই যাচ্ছিলাম আপন মনে । আমরা তখন থাকি বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে । হটাত, একেবারেই হটাত একটা বাড়ির সামনে আসতেই শুনতে পেলাম ভিতরে রবীন্দ্র সঙ্গীত চলছে । দাড়িয়ে পড়লাম এবং বুঝলাম যে ক্লাস চলছে। অপূর্ব, উদাত্ত পুরুষ কণ্ঠের উচ্চারন শুনে আমি স্তম্ভিত । বাকরহিত। “ আমায় থাকতে দে না, আপন মনে “। এ তো সাগর সেনের গলা ! বাড়িটার সামনের ছোট লোহার গেটের পাশে সাদা পাথরে লেখা – রবি রস্মি। সম্বিত ফিরতে বুঝলাম আমি মহানির্বাণ রোডে সাগর সেনের ডেরার সামনে। কোন কিছুর আকর্ষণ যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছয় , তখন দিগ্বিদিক জ্ঞ্যন শূন্য হয়ে যায় । এক ঔদ্ধত্য কাজ করে। ওই বয়েসে ওইখানে আমার তখন একই অবস্থা । ভয়ও করছে ঢুকবো কি না ভাবছি আবার দুর্নিবার আকর্ষণও হচ্ছে।

ঢুকেই পড়লাম । পায়ে পায়ে সেই বাঁদিকের ঘড়টার দরজার দিকে আমায় কে যেন টেনে নিয়ে গেলো । হটাত সব চুপ । আমাকে দরজার সামনে দেখে ভিতরে বসে থাকা ঋজু , ব্যাকব্রাশ করা চুলের নিচে মোটা ফ্রেমের চশমার ভিতরে দুরন্ত আকর্ষণীয় দুটি চোখ আমার দিকে তাকিয়ে । “ কে আপনি , কি চাই , ভিতরে আসলেন কি করে ? “ জ্বলদ গম্ভীর গলা। আমার তো গলা শুকিয়ে কাঠ। ততক্ষনে আমার দিদি ও অন্যেরা আমাকে দেখে ফেলেছে। আমিই দিদিকে দেখিয়ে বললাম ইন্দ্রানী, আমার দিদি – তাই এলাম। দিদি এগিয়ে এসে ওঁর শিক্ষক গুরুকে আশ্বস্ত করেছে – সাগর দা, ও আমার ভাই – রজত। আপনার গানের পাগল । বরফ গলল । আমাকে ভিতরেই বসতে অনুমতি দেওয়া হোল এবং আবারও ক্লাস শুরু হোল । ক্লাস শেষও হোল একটা সময়ে । এবার ওঠার পালা । সাগর সেন দিদি কে বললেন ওকে নিয়ে পরের দিন এসো, বলে, আমার দিকে তাকালেন – আবার এসো ।

খুব সংক্ষেপে প্রথম পরিচয়টা বলা গেল । গান আমি ভালবাসি সেই ছোট্ট বয়স থেকেই, তা নাহলে , বাবার হাত ধরে বঙ্গ সংস্কৃতি সন্মেলনে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত আসরে সারা রাত কাটাই ! কিন্তু গান আমার জন্য যে নয় তাও জানতাম । তবু, কেন জানি না, মন্ত্রমুগ্ধের মত পরের বুধবার আবারও হাজির রবি রস্মি তে। এক কোনে বসে শুনছিলাম । হটাত ছন্দপতন । সাগর সেন আমার দিকে তাকিয়ে বললেন – রজত – গান শিখবে ? আমি না না করে উঠতেই, দিদির দিদিগিরি – ও কিন্তু ভালই গায় । সাগর সেন তাকিয়ে আছেন – বললেন – একটা শোনাও তো ? আমার কি হোল – আবারও ঔদ্ধত্য কাজ করে ফেললো । আমি ধরলাম – যে গানটি আমার তখনও প্রেমিকা, পরে বউ –তাকে প্রথম দেখায় শুনিয়েছিলাম বালিগঞ্জ লেকে জলের ধারে বসে – ‘ আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী ‘ – ওনারই গান । গাইতে গাইতে দেখলাম, উনি নিজেই হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন আমার গানের সাথে । এবং, এবং , আমার সাথেই উনি নিজে গলা দিলেন শেষ দুটি লাইনে – ‘ আমি শুচি আসন টেনে টেনে বেড়াবো না বিধান মেনে – যে পঙ্কে ওই চরন ‘পরে, তাহারই ছাপ বক্ষে মাগি’ । গান শেষ হোল । এক অনন্য প্রশান্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম – বললাম – আমি আসি সাগর দা । সাগর সেন হয়ে গিয়েছিলেন সাগর দা – কয়েক মুহূর্তের মধ্যে । উনি বললেন – নিয়মিত আসবে। শিখবে । আমি মাথা নেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম । তবে, আর কোনদিন গান শিখতে ওই বাড়িতে যাই নি। যদিও সাগর দার সাথে হৃদ্যতা এর পরে বহুগুন বেরেছিল।

সাগর দা কে নিয়ে একক অনুষ্ঠান করেছি একাডেমীতে । রবীন্দ্র –নজরুল সন্ধ্যা করেছি – সুমিত্রা সেন, সাগর সেন আর অনুপ ঘোষাল কে নিয়ে – শিশির মঞ্চে। সেই সময়ে, আমি কখনো রবীন্দ্রসদনে , শিশির মঞ্চে অডিটোরিয়াম এ বসিনি। সাগরদার নাম করে সদাই স্টেজে আমার উপস্থিতি । মনে আছে, আমার দিদির গান – ‘ছায়া ঘনাইয়াছে বনে বনে’ – শুনে উইংসের ধারে সুমিত্রা সেন জরিয়ে ধরেছিলেন দিদিকে। সাগর দা সামনেই ছিলেন। বলেছিলেন – এটাই তোমার সেরা পাওনা ইন্দ্রানী ।

সাগর দা খুব ভালো স্টেজ অর্গানাইসার ছিলেন। সময়ের থেকে অনেক অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন সঙ্গীত সাধক হিসেবে। উনিই প্রথম, রবীন্দ্রসঙ্গীতে গীটার ব্যবহার করে এক অন্য মাত্রা এনে দিয়েছিলেন। উনি ছিলেন একাধারে এক অসাধারন শিক্ষক, মেন্টর। প্রচুর চ্যারিটি প্রোগ্রামে উনি কত দুঃস্থ কে সাহায্য করেছেন, নিজে কাছ থেকে দেখেছি। প্রকৃত অর্থেই উনি ছিলেন ভালবাসার সাগর।

অসাধারন এই মানুষটা, ছিলেন ক্ষণজন্মা। মাত্র ৫০ এ, ১৯৮৩ র ৪ঠা জানুয়ারি চলে গেলেন গলায় মারন রোগ নিয়ে – অসংখ্য ভক্ত ও গুনমুগ্ধদের রেখে । তবে যাবার আগে যা গেয়েছেন ও রেখে গেছেন, সে এক অফুরান্ত ভান্ডার । ওঁর আগে ও পরে অনেক রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী গান গেয়েছেন । প্রথিতযশা বেশ কিছু গাইয়ে। সম সাময়িকীরা তো ছিলেনই। কাউকে ছোট না করে, এতোটুকু অশ্রদ্ধ্যা না দেখিয়েও এটুকু বলতেই পারি, সাগর সেন ছিলেন প্রথম আধুনিক রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইয়ে। যার গায়কীতে ছিল এক অসামান্য মেদুরতা আর একই সাথে ছিল উদাত্ত কণ্ঠও। সাগর সেনের লেজেন্ড, ওঁর মডেল গায়কীতেই ধরা থেকেছে। ওঁর মত স্পষ্ট উচ্চারণে আর কেউ গেয়েছেন কিনা আমার শোনা নেই। পরের প্রজন্মের মধ্যে তো কাউকেই পেলাম না। ওই কণ্ঠ , ওই সুরে গাওয়া, ওই গায়কী আর পাওয়া গেল না। প্রেম ও পূজা পর্যায়ে সাগরদা অনবদ্য ভাবে স্বকীয় । ব্রম্যসঙ্গীতেও ওঁর গাওয়া রবীন্দ্র গান গুলি অসামান্য ছিল, পরিবেশনায় । একেবারে শেষ দিকে যখন ওঁর গান গাওয়া বারন তখনও নতুন করে রেকর্ড করেছেন, অনেক আগেই গাওয়া – ‘ প্রতিদিন তব গাথা গাব আমি সুমধুর’। রবীন্দ্রসঙ্গীতকে সহজ করে সুরেই গাওয়া যায়, সেটা সাগরদাই প্রথম শুনিয়েছিলেন।

এতো উচ্চমার্গের গাইয়ে হয়েও, সাগর দার জোটেনি কোন সর্বভারতীয় পুরষ্কার বা স্বীকৃতি। একবার বিএফযেএ পুরস্কার ছাড়া এতোবড়ো শিল্পী রয়ে গেছেন পাদপ্রদিপের আলোর থেকে দূরে। তবে সাগরদার স্বীকৃতি, ওঁর অসংখ্য গুনমুগ্ধদের কাছে যারা আজো উৎসুক হয়ে ইউ টিউব হাতরে সাগরদার গানের লক্ষ লক্ষ সাবস্ক্রাইবার থেকেছেন। ‘৮৩তে চলে যাওয়া মানুষটার গান আজকের প্রজন্ম সমান ভালবাসায় আপন করে নিয়েছে এটাই আমাদের প্রাপ্তি। আর কোন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর এতো ফলোয়ার ভাবাই যায় না। এখানেই সাগর সেন অনন্য। ভালবাসার আদরে, ওঁর অন্তিম যাত্রায় ছাত্রছাত্রীরা গাইতে গাইতে চলেছিলেন – ‘আর কত দূরে আছে সে আনন্দধাম’ ও ‘আজি শুভদিনে পিতার ভবনে অমৃত সদনে চল যাই’ এবং আরও অনেক গান। সাগর সেন হৃদয়ে থাকবেন যতদিন এই গানগুলি আমরা শুনতে থাকবো।

Featured Image : courtesy Internet.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here