রজত শুভ্র চ্যাটার্জি

০০৩৭

আজ ২৫শে বৈশাখ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। শুভ জন্মদিনে প্রনাম।
শুধু তো জন্মদিনে নয়, রবীন্দ্র স্মরন যে কোন দিনেই, যে কোন অবস্থাতেই করা যায়, এমনই ওঁর ব্যপ্তি। রবীন্দ্রনাথ – আমাদের জীবনে সুখে –দুঃখে, আনন্দে – বিষাদে পুজো –সামাজিকতায় এমন ভাবে জড়িয়ে আছেন – তবু, রবীন্দ্রনাথের ব্যাক্তিগত জীবনের উপর আমরা কখনই সেভাবে তাকিয়ে উঠতে পারিনি। অথচ, একটু গভীর মনোযোগ দিলেই আমরা দেখতে পাই, রবীন্দ্রনাথ হলেন –
একের পর এক ব্যাক্তিগত শোক অতিক্রম করে পূর্ণতায় উত্তরনের এক অনন্য উদাহরন। কবির কলমে তাই তো ঝরে পড়েছে , ” বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি ”।

কবির জীবনে- প্রথম মৃত্যু তো ১৮৮৪ তে যেদিন কাদম্বরী দেবী চলে যান । তখন অবশ্য রবি নিতান্তই তরুন। কিন্তু ওই ঘটনা, রবি – মনে গভীর ও দীর্ঘ ছায়া রেখাপাত করেছিল তা তো আমরা পেয়েছি তার রচনায় – “ আমার প্রানের ‘পরে চলে গেলো সে ”—-

কবির জীবনে দ্বিতীয় মৃত্যু মিছিল পর্ব শুরু – ১৯০২ সালের ২৯ নভেম্বর যেদিন স্ত্রী মৃণালিনীর প্রয়ান ঘটে। কয়েক মাস পরেই, এবার অসুস্থ হলেন মেজো মেয়ে রানী । হাওয়া বদলের জন্যে মেয়েকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ গেলেন আলমোড়ায়। কিন্তু, রানীর অসুখ বেড়ে গেলো। ঠিক হোলো – ওকে ফিরিয়ে আনতে হবে। ডাক্তার বললেন – যা অবস্থা, তাতে,
একেবারে শুইয়েই ফিরিয়ে আনতে হবে। তো, পাহাড় থেকে রানীকে একেবারে খাট শুদ্ধ নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হোল । আর রবীন্দ্রনাথ – পুরো ৩২ মাইল রানীর পাশে পায়ে হেঁটে পাহার থেকে নামলেন। রাত হয়ে গেছে তখন অনেক।
সেই যুগে, ইংরেজরা – নেটিভদের কোনো সুযোগ দিতে চাইত না। রবীন্দ্রনাথকে অগত্যাই, সারাটা রাত এক ধর্মশালার বারান্দায় অসুস্থ মেয়েকে পাশে নিয়ে কাটাতে হোল। অবাক করা ব্যাপার, পরদিন সকালে তিনি আবিষ্কার করলেন যে – তার টাকা পয়সা ভর্তি ব্যাগটি ওই রাতে খোয়া গিয়েছে। কপর্দক শূন্য রবীন্দ্রনাথ এই ঘটনায় বলেছেন –
“ তার চেয়ে মনে করলেই তো হোল – যে নিয়েছে টাকাটা, হয়ত তার প্রয়োজন অনেক বেশি আমার থেকে। তাই ধরেই নিচ্ছি, ওটা আমি দান ই করলুম। ”
কল্পনা করা যায় ? উদাত্ত্য মহাকাব্যে নয়, বিচ্ছিরি গ্লানীময় বাস্তবে একজন রক্ত মাংসের মানুষ, ওই পরিস্থিতিতে গ্রহন করলেন এমন এক স্ট্র্যাটেজি !!

কলকাতায় আনার কিছুদিন পরই রানী মারা গেলেন। ১৯০৩ সালে। যে দুপুরে রানী চলে যান, সেই সন্ধ্যেতেই রবি বাবুর বৈঠক খানায় ঠিক ছিলো বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ সভা। অনেক রাতে – সভা শেষে – রবীন্দ্রনাথ অথিতিদের এগিয়ে দিতে দরজা পর্যন্ত এসেছেন,
এবং, মলিন হাঁসি মুখেই বিদায় জানাচ্ছেন সবাই কে। রামেদ্রসুন্দর ত্রিবেদী – বেরুনোর মুখে জিজ্ঞেস করলেন – “ রবিবাবু, আপনার মেয়ে আজ একটু ভালো তো ?”
শান্ত রবীন্দ্রনাথ বললেন, “ আজ দুপুরে সে মারা গিয়েছে” ।

দ্বিতীয় পর্বের মৃত্যু মিছিলে ১৯০৫ সালে দেবেন্দ্রনাথের প্রয়ান রবীন্দ্র জীবনে তৃতীও আঘাত। তবু, কঠিনতম আঘাতটি রবীন্দ্রনাথ পান যেদিন ছোট ছেলে শমিন্দ্রনাথ, ১৯০৭ এর ২৪ শে নভেম্বর প্রয়াত হলেন কিশোর বয়েসে। এটাও কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। শমীন্দ্রনাথ, মুঙ্গেরে যে রাতে মারা গেলেন সেই রাতেই, দাহ সাঙ্গ হওয়ার পর – কবি ট্রেনে চেপে ফিরছিলেন সঙ্গী দুই অধ্যাপকের সাথে। সাহেবগঞ্জ স্টেশনে এক অধ্যাপকের মামা দেখা করতে এলেন রবীন্দ্রনাথের সাথে। হেঁসেই কুশল বিনিময় করলেন তার সাথে। বুঝতেই দিলেন না – যে ঘন্টা কয়েক আগেই হারিয়েছেন প্রানাধিক প্রিয় ছোট ছেলেকে।
ট্রেন ছাড়ার মুখে, যখন সেই অধ্যাপক বন্ধু জানলেন- কবির পুত্রশোকের কথা – তখন তিনিও বিহ্বল –রবীন্দ্রনাথের ওই অমানুষিক ক্ষমতা দেখে। উত্তর অবশ্য কবি কে দিতে হয় নি কারন, ট্রেন ততক্ষনে প্ল্যাটফর্ম ছারিয়েছে। প্রচণ্ড ভাঙ্গনের মুখেও তিনি অবিচল থাকতে পেরেছেন।

পর পর স্ত্রী, কন্যা, পিতা, পুত্রের মৃত্যু রবীন্দ্রজীবনে তীব্র ভাঙ্গনের সূচনা করে। গাছের একটা পাতা ঝরে পড়লেও রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ে তার দাগ থেকে যেতো । এতো নরম মনের মানুষ হয়েও – এতো নিরাসক্ত ভাবে প্রানপ্রিয় জনদের মৃত্যুকে কেমন করে গ্রহন করতে পেরেছিলেন ? এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন –

“ শমী যে রাতে চলে গেলো, সেই রাতে, রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে । আমার ব্যাক্তিগত শোকে কোথাও কিছু কম পড়েছে তার তো লক্ষন নেই ”?

তাই এমন ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মাঝে দাড়িয়েও তিনি গঠনের স্বপ্ন দেখলেন। আর তাকে সত্য করে তুললেন । বিলেত ফেরত রথীন্দ্রনাথের সাথে বিয়ে দিলেন বৈধব্য যন্ত্রণায় পাথর প্রতিমা দেবীর । ঠাকুরবাড়ির প্রথম বিধবা বিবাহ – ২৭ শে জানুয়ারী, ১৯১০। বিবাহের বারো দিনের মাথায় তিনি পুত্র ও পুত্রবধুকে নিয়ে চলে যান শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক পরিবেশে।

বধু বরনের পর, বর কনে এগিয়ে আসতেই, রবীন্দ্রনাথ তার দুদিকে রাখা দুটি আসনে দুজনকে বসিয়ে ‘পিতা নহসি’ মন্ত্রপাঠের পর যে উপদেশ দিয়েছিলেন, তার ভাবার্থ প্রতিমা দেবীর গভীরে রেখাপাত করেছিল। ওই পরিমণ্ডলে থেকে, প্রতিমা দেবীর মনেও সাহিত্য সাধনার ইচ্ছে জেগে ওঠে । রবীন্দ্রনাথ নিজে তার লেখা সংশোধন করে দিতেন। এই ভাবেই প্রতিমা দেবীর রচনা পরিনতি লাভ করে। তাই তো, মহুয়া কাব্যগ্রন্থের ‘ প্রতিমা ‘ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ একেছেন এক নিপুন চিত্র –

“ কনামাত্র সে হীণতা
নাহি কহে কথা
কেহ না দেখিতে পায়
নিত্য যারা ঘিরে আছে তায়।
অমরার অসীমতা মাটিতে নিয়েছে সীমা-
নাম কি প্রতিমা।“

রবীন্দ্রনাথের কাছে জীবন ছিলো পূর্ণ সময়ের কাজ। তার জন্য সচেতন চেষ্টা করে গেছেন। সেই চেষ্টার অভ্যেস তৈরী করেছেন। প্রিয়জন বিয়োগ তো নিয়ম হয়ে গিয়েছিলো ওঁর জীবনে। তবু শিল্পী স্বত্বা কে আলাদা রেখেছিলেন ব্যাক্তি স্বত্বা থেকে। হৃদয় থেকে – ব্যাক্তিগত কোমল, মরমী লতাগুলিকে একে একে উপড়ে ফেলে, নিজের সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন। যে পরিমান অসহ্য শোক, তাপ এসেছে তার জীবনে – তারপর ও তিনি লিখছেন –

“ ঈস্বর আরো দুঃখ যদি দেন – তো তাহাও শিরোধার্য করিয়া লইব। আমি পরাভূত হইব না ” ।

“ দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে “…

Featured Image : Internet

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here