রজত শুভ্র চ্যাটার্জি
০০২৭
ময়দানে মরক চলছে ২০২০ থেকেই। সমাজের অন্যান্য জগতের মতোই, কলকাতা ময়দানেরও ছার চলছে না মৃত্যু মিছিলের হাত থেকে। প্রদীপ ব্যানার্জি, চুনী গোস্বামী, অশোক চ্যাটার্জি থেকে প্রণব গাঙ্গুলী, ভবানী রায় হয়ে সুভাষ ভৌমিক এবং সুরজিত সেনগুপ্ত। আগে পরে আরও অনেকেই চলে গেলেন । এ এক অভিশপ্ত অধ্যায়।
কালের নিয়মে তিরোধান তো স্বীকার্য। তবু, সত্তর দশকের গর্বরা যখন এইভাবে চলে যাচ্ছে, তখন বেদনা অনুভূত ও পুঞ্জীভূত হচ্ছে।
ভৌমিকের ব্যাপার দিয়েই শুরু করি। আমার শেষ বইটার উদ্বোধনে, ২০২১ এর ৩০ শে জানুয়ারির একবছরও কাটলো না। ও চলে গেলো। যখনই কথা হতো, ওই একই ভাবে কিছুই তোয়াক্কা না করা স্বভাবে সবকিছু উড়িয়ে দিয়েছে। আমার বইয়ের ভূমিকা লেখার অনুরোধে, ভৌমিকের প্রশ্ন ছিল – তুমি কতটুকু জানো ভারতীয় ফুটবল নিয়ে। আমি বলেছিলাম – তুমি যতটুকু জানো, আমি তার থেকে আর একটু বেশি জানি। এরপর আর কথা বাড়ায় নি।
চুনীদা বলেছিলেন, সুব্রত ভট্টাচার্য কে দিয়ে আমার বই – ফ্যাব ফাইভের ভুমিকা লেখাতে। চুনীদার অবর্তমানে, আমি কিন্তু, ভৌমিকের শরণাপন্নই হয়েছিলাম। এবং অসাধারণ ভূমিকা পেয়েছিলাম ভৌমিকের কাছ থেকে। কারন, পরের প্রজন্মের মধ্যে, একমাত্র সুভাষই তবু কিছুটা কাছে থেকে দেখতে পেয়েছিল ওই ফ্যাব ফাইভ কে।
তুল্য মূল্য বিচারে, চুনীদা, বলরামদা কিন্তু সুভাষ ভৌমিকের আগেই রেখেছেন সুরজিত সেনগুপ্ত কে। চুনী দা বলতেন, আমার পরে, জংলা ( পরিমল দে), আর কাজল। তার পরেই সুরজিত। ওই পায়ের কাজ আর কারো কাছে পাইনি। প্রদীপ দা অবশ্যই ভৌমিককে এগিয়ে রেখেছেন – শক্তিশালী কাঠামোর জন্য।
আজ এরা প্রায় কেউই নেই – বলরাম দা আর অরুণ দা ছাড়া। দুজনেই নড়বড়ে। তবু, মনে হয়, প্রদীপদা ই হয়তো ঠিক। সুরজিত, সেই ভাবে বড়ো ম্যাচ কায়দা করতে পারেনি। না পাঁচ গোলের ম্যাচেও না। খুব সুন্দর গোল হয়তো অনেক করেছে, তবু, সেই তীব্রতার অভাব কোথাও লেগে থাকতো।
সুরজিতের সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় আজকাল পত্রিকার দপ্তরে। অনেক আড্ডা হয়েছে আশির দশকে। ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে, বিভিন্ন ব্যাক্তিগত পরিসরে সুরজিতের অসাধারন গান শুনেছি। অনেক আগে ওই ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতেই শুনেছি সুকুমার সমাজপতির গান। সুকুমারদার ছিল শেখা গলা। কি গাইতেন। এরপর কাজল দা কেও গাইতে শুনেছি। অশোক চ্যাটার্জি খুব ভালো গাইতেন। সুরজিত ও সেই রকম খুব খুব ভাল গাইতো। এদের প্রত্যেকের ছেলেরা ভালো গাইয়ে ও বাজিয়ে হয়েছে। কুমার মুখার্জি আর সন্দিপন সমাজপতি খুব ভালো উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গাইয়ে । সন্দীপ চ্যাটার্জি খুব ভালো সন্তুর বাজিয়ে। সুরজিতের ছেলে, স্নিগ্ধদেব বাংলা মৌলিক গানে রীতিমতো নামী । আরো একটা ঘটনা। যে কটা নাম করলাম এরা প্রত্যেকে মানুষ হিসেবে অসাধারন – ভদ্র, মার্জিত, অমায়িক। সৌজন্য এদের ঘিরে থাকতো। আমার ছেলের বিয়েতে সুরজিত হাসতে হাসতে বলেছিল – সেই তো আজকাল পরিবারেই বিয়ে দিতে হোল? আসলে, আমি আজকালে লেখা বন্ধ করেছিলাম কিছুটা অসন্তোষ ও অভিমান নিয়েই। সুরজিত জানতো । তাই ওই সুরসিকতা ।
সুরজিতের শৈল্পিক ফুটবল নিয়ে এতো লেখা হলো, আমার আর নতুন কিছু যোগ করার নেই । হা হুতাশ ছাড়া । তবু, পিয়ারলেস ট্রফির সেমি ফাইনালে – ‘৮৩ তে – ইস্টবেঙ্গলের বিপক্ষে, মোহনবাগানের হয়ে ও ডান পায়ের চেটর বাইরের দিক দিয়ে ফ্লিকে যে গোলটা করেছিল, সেটা মনে থাকবে বহুকাল। ক্রিকেটের পরিভাষায় যাকে বলে ক্ল্যাসিকাল লেগ গ্লান্স। ভাস্কর দাঁড়িয়ে দেখেছিলো – বলটা গোলে চলে যাচ্ছে। অনেক পরে, খেলা ছাড়ার পর একটা ঘটনা আজ মনে পড়ছে ।
ফুটবলারস ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন আয়োজন করেছিল এক প্রদর্শনী ম্যাচের – রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে। আশির দশকের শেষ দিকে। সংগঠনের একজন হয়ে আমিও হাজির মাঠে। সদ্য খেলা ছাড়া ও একেবারে সেই সময়ের তরুনদের নিয়ে গঠিত দুই দলের প্রীতি ম্যাচ। খেলা ছাড়াদের দলে সুরজিত, সমরেশ, গৌতম, মোহন সিং, শ্যামল ঘোষ, শ্যামল ব্যানার্জি, কম্পটন দত্ত ও অন্যান্যরা। বিশেষ অথিতি হয়ে উপস্থিত ছিলেন , প্রদীপদা, চুনিদা, অরুন দা ও আরও অনেকে।
মাজিদ বাস্কর তখনও কলকাতায়।
হটাৎ সুরজিত এসে আমাকে বললো, রজত দা যদি তোমার গাড়িটা পাওয়া যেতো খুব ভালো হতো। আমি বললাম, হ্যা বলো, কি করতে হবে। ও বললো, আমার সাথে একটু যাবে, মাজিদ কে নিয়ে আসবো। এমনিতেই না বলার কোনো কারণ ছিলনা। তার ওপর মাজিদকে একেবারে সামনে থেকে পাওয়ার লোভটা ম্যাজিকের মতো কাজ করলো। আমার ছোট ভাই হীরক আর সুরজিত কে নিয়ে ইলিয়ট রোডে মাজিদের মেসে গিয়ে ওকে নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। জীর্ণ, রিক্ত, শীর্ণ এক চেহারার মাজিদ বাস্কার। দেখে মায়া হলো। কি চেহারা কি হয়ে গিয়েছিল ! অথচ, একেবারে হাতের মুঠোয়। প্রচুর প্রশ্ন ও উত্তর আজ আর গুছিয়ে লেখার অবস্থায় নেই। মনে আছে, জিজ্ঞেস করেছিলাম, এতো গোল যে করেছো, এতো গোলের বল যে সাজিয়ে দিয়েছো, এটা কি করে পারলে ? মাজিদ পাশে বসা সুরজিতের কোমরে কনুই দিয়ে গোত্তা মেরে বলেছে – এই যে ছেলেটা বসে আছে, ওর জন্যই পেরেছি যা কিছু খেলতে। ভাবা যায় এইরকম স্বীকারক্তি! মাজিদ বলছিল, কখনো রাইট উইং – কখনো লেফট উইং থেকে মাপা সেন্টার করতো সুরজিত। একবারে আমার পায়ে অথবা আমার আর জামশিদের মাথায়। কখনো, সুরজিত এমন থ্রু বাড়াতো ঠিকানা লেখা, আমার আর জামশিদের পায়ে। আমরা মহা আনন্দে গোল করে যেতাম। আধা ইংরেজি, আধা উর্দুতে যা বলেছিলো মাজিদ, বুঝতে অসুবিধে হয় নি। একই কথা শুনেছি, সাব্বির আলির থেকেও – সুরজিত সম্পর্কে।
সুরজিতের ফুটবল নিয়ে এটাই বোধহয় শেষ কথা হতে পারে । শান্তিতে থেকো ক্যাপ্টেন।