রজত  শুভ্র  চ্যাটার্জি

০০১১

রবীন্দ্রনাথ কে দেখিনি। কিন্তু তিনি আমাদের জীবনে অবিচ্ছেদ্য – ওকে পেয়েছি  ওর অপার মহাসাগরীয় ভান্ডার থেকে।  সত্যজিৎ কে সামনে  পেয়েছিলাম আমার তরুন বয়েসে ক্ষণিকের জন্য। সে এক পাহার প্রমান অভিজ্ঞতা। কিন্তু, ওকেও মূলত পেয়েছি ওর তৈরি অফুরান কীর্তির মধ্যেই। সৌমিত্রকে কিন্তু পেয়েছিলাম, একেবারে পাশে,  কিছুকাল আগে।   সাহিত্য, কবিতা, দর্শনের গভীরতা মনে হয়েছে ওনার অভিনয় ক্ষমতার থেকেও বেশী বহুমুখী ।  শিহরিত হই  ভেবে যে একজন মানুষ এতো  কিছু জানতেন এবং বোঝাতে পারতেন কি করে। এই মানুষটিই তাহলে রবীন্দ্রনাথ ও সত্যজিতের পরে সেরা সাংস্কৃতিক বাঙালি ! আমার বিস্ময় আর তাতে মোহিত হওয়া এক ব্যাপার। কিন্তু আমারই অনুজ ভ্রাতা, হীরক শুভ্র ছিলো সৌমিত্রর খুব কাছের। আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা তুষার শুভ্রর ব্যাক্তিগত ওনাকে কাছে পাওয়ার ঘটনাটাও কম আকর্ষিত নয়।  ওদের  উপলব্ধি, তাই আমার ব্লগে দিলাম, আর নিজের পিঠ নিজেই চাপড়ে নিলাম।

—————————

সৌমিত্রহীন একটা বছর।

হীরক শুভ্র চট্টোপাধ্যায়

কেটে গেল মন খারাপের একটা বছর । বাঙালীর সাংস্কৃতিক বনস্পতি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ঠিক একটি বছর আগে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন সম্পূর্ণ করে পাড়ি দিয়েছেন নিশ্চিন্দিপুরে অসীম এর উদ্দেশ্যে । আমাদের চোখ ভিজেছে নিজের অজান্তেই ।

নিজেই লিখেছিলেন – “মৃত্যু এমনই চূড়ান্ত স্টেশন যে তার ওপারে আলো নেই । হয়তো অন্ধকারও না ।” দীর্ঘ সময় অভিনয় করে প্যাক আপ হতেই পূর্ণিমার চাঁদের ওপর রোলার স্কেট করে তারা হয়ে গেলেন । বেঁচে থাকলে জগজিৎ সিং নির্ঘাত গেয়ে উঠতেন – ‘তেরি দুনিয়া মে জিনে সে তো বহতর হ্যায় কে মর যায়ে ।’

ফেলুদা, তোমায় ছাড়া আমাদের যৌবন সত্যিই অপূর্ণ থেকে যেত । আজ অবধি যৌবনটাকে নিজের মনের মধ্যে যে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি, সে বুঝি তোমাকে নিয়ে যে ইমেজারিটা তৈরী হয়েছে, সেই মননটা কিছুতেই অপুর সংসার, ক্ষুধিত পাষাণ, ঝিন্দের বন্দী, চারুলতা, সোনার কেল্লা, তিন ভুবনের পারে, ছুটির ফাঁদে, বসন্ত বিলাপ বা প্রথম কদম ফুল ছাড়া গড়ে উঠত না । কানে ভাসে – ” জীবনে কী পাবোনা ভুলেছি সে ভাবনা” বা ” হয়তো তোমারই জন্য হয়েছি প্রেমে যে বন্য” । কেবল অপু বা ফেলুদা নয়, কম আলোচিত ছবিগুলো যেমন বর্ণালী, জোড়াদিঘীর চৌধুরী পরিবার, একটি জীবন, মহাশ্বেতা, অগ্রদানী থেকে শুরু করে শেষ জীবনের ছবিগুলো বসু পরিবার, বাঁশিওয়ালা, তখন কুয়াশা ছিল, বরুনবাবুর বন্ধু, কৃষ্ণকান্তের উইল, বেলাশুরু, অভিযান পর্যন্ত প্রতিটি ছবিতে তাঁর অভিনয়, বাচনভঙ্গী, ও শরীরী ভাষার প্রয়োগ দেখলেই মনে হবে বই এর পাতা থেকে উঠে আসা এক একটি চরিত্র ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সত্যজিৎ রায়ের পর প্রতিভার বহুমুখীতার বিচারে তৃতীয় সেরা আন্তর্জাতিক বাঙালীর নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় । অথচ তাঁকে সারাটা জীবন ‘ফাইট কোনি ফাইট’ করতে হয়েছিল । জানতেন তিনি champion নন, challenger । উত্তম 2 হতে চাননি, চেয়েছিলেন সৌমিত্র 1 হতে । ‘ঝিন্দের বন্দী’তে টক্কর দিলেও ‘স্ত্রী’ ছবিতে graceful উত্তমের পাশে ম্লান দেখাতেই স্টার হতে আর চেষ্টা করেননি । স্টারডমের সঙ্গে না দৌড়ে স্বতন্ত্রপথ বেছে নিয়েছিলেন । ছবি বিশ্বাসের অভিনয় ধারাকে ঘা দিয়েছিলেন উত্তমকুমার, এবার উত্তমকুমারের stylization এ বড় ধাক্কা হানলেন তাঁর প্রিয় পুলু । Motion picture application on stage আর stage acting application in motion picture – এই দুই এর একটা সার্থক সমন্বয় সাধন করলেন সৌমিত্র নামক এক জীবনশিল্পী । জ্যামিতিক অগ্রগতিতে সৌমিত্রর কেরিয়ার ধাবিত হয়েছে । তাঁর আমলেই পেশাদারী মঞ্চ হয়ে উঠলো গ্রুপ থিয়েটারের আঙিনা । তিনি মঞ্চের মহীরূহ হয়ে উঠেছিলেন ।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যতটা অভিনেতা, কবি হিসেবে তার থেকে কোন অংশে কম নন । শিকড়বিহীন অপু তাই অনিবার্যভাবে ধরা পড়ে তাঁর কবিতায় – “যেন বা শিকড় তার নেই, শিকরের স্থলাভিসিক্ত কোন অভিমান নেই “। ‘নামজীবন’, ‘বিদেহী’ ‘রাজকুমার’ নাটক থেকে শুরু করে ‘আত্মকথা’, ‘ঘটক বিদায়’ , ‘টিকটিকি’, ‘হোমাপাখি’, ‘রাজা লীয়র’ হয়ে ‘ফেরা’ বা ‘কালমৃগয়া’ পর্যন্ত যাত্রাপথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে উচ্চারণ করেছেন তাঁর জীবনবোধের সারাংশ । আশায় থাকি আমরা, কোন এক শীতের রাতে উনি ঠিক ফিরে আসবেন, যেমনটি লিখেছিলেন জীবনানন্দ – ‘একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব, আবার কী ফিরে আসবনা আমি পৃথিবীতে ? আবার যেন ফিরে আসি কোন এক শীতের রাতে’ । প্রিয় উপন্যাসের পাতা ওড়ানোর সময় অপু সহ সমগ্র পরিস্থিতিকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন সত্যজিৎ রায় এভাবে –

” The Apu lets the whole manuscript go,

And they seem like an enormous

Flock of some strange migratory

Birds disappearing into the depths

Of the mountain” ।।

——————————

সৌমিত্র র সাথে –

তুষার শুভ্র  চ্যাটার্জি

আমি গাড়ি চালাচ্ছিলাম, সামনে আমরা দু ভাই, পেছনে ফেলুদা। রাত দশটা বেজে গেছে।  গাড়িতে ওঠার আগে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার কোনো অসুবিধে হবে না তো?”

আমার অসুবিধে তখন বিশ্বনাথের মন্দিরের পায়রার মতন ঝটপট করে উধাও। ঘন্টা দুয়েক সন্ধেবেলা আমাদের পরিবারের মাঝে ছিলেন। গাড়িতে চুপচাপ। এমনিতে কথা বললেই উত্তর দেন। এমন সময় আমার ছেলের ফোন । Christ College এ পড়তো। উত্তরে আমি বললাম, “জানো কার সঙ্গে আছি?” পুত্র জিজ্ঞেস করলো, “কে?” “ফেলুদা”। উত্তরটা তার কাছে এমনই অপ্রত্যাশিত ছিল  যে চমকিয়ে বললো,” কে ফেলুদা?” “সত্যিকারের ফেলুদা?” উনিও হাসছেন। পুত্র আবদার করে বসলো, “আমাকে একবার hello বলতে বলবে?” আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম। “ছেলে। Bangalore এ থাকে। একবার hello বলবেন?” “নিশ্চই” । বলে ফোন টা নিয়ে দু চার কথা ছেলের সঙ্গে। আশীর্বাদ দিলেন।

অপুর সংসার থেকে অপু চলে গেছে একবছর হোল। রেখে গেছে, ৬০ বছরের অনবদ্য সৃষ্টি কলা। যেদিন মূল্যায়ন হবে বাঙালি আরো সমৃদ্ধ হবে।

Featured Image : Courtesy : Facebook

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here